রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ০২:০৪ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
উদ্ধার ইয়াবা ঢুকল ডিবির পকেটে

উদ্ধার ইয়াবা ঢুকল ডিবির পকেটে

স্বদেশ ডেস্ক: ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল ঢাকার অদূরে গাজীপুরের শিল্প এলাকা টঙ্গীর একটি বাসায় অভিযানে যায়। এক লাখ পিস ইয়াবাসহ এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে তারা। কিন্তু এ ঘটনায় দায়ের মামলায় রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় অভিযান চালানোর কথা উল্লেখ করা হয়। জব্দ তালিকায় দেখানো হয় ১০ হাজার পিস ইয়াবা। এখানেই শেষ নয়, গ্রেপ্তার আসামির পরিবারের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় ৩২ লাখ টাকা। আরেকজনকে আসামি তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলে তার পরিবারের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেন ডিবির এক কর্মকর্তা।
ডিবির করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ সালের ২ মার্চ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ডিবির আভিযানিক দল জানতে পারে, রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার সাতরাস্তা মোড়ে দুই মাদক ব্যবসায়ী ইয়াবা বিক্রির জন্য অপেক্ষা করছে। ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে এক মাদক ব্যবসায়ী পালিয়ে যায়। এ সময় শাহিদা আক্তার নামে এক নারীকে ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তির নাম শাকিল।
ডিবির তেজগাঁও জোনাল টিমের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (এসি) শিবলী নোমানের নেতৃত্বে অভিযানে অংশ নেন পরিদর্শক আব্দুল মতিন ও মাজেদুল ইসলাম, এসআই জুলফিকারুল ইসলাম, এএসআই আনোয়ার হোসেন, এমরান আলী, মিজানুর রহমান ও আব্দুল মুনসুর এবং কনস্টেবল এ জি এম শরিফুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম ও খাদিজা পারভিন।
আমাদের সময়ের সেই প্রতিবেদন : গত ১৭ এপ্রিল দৈনিক আমাদের সময়ে ‘ছাত্রলীগ নেতার হাতে টঙ্গীর ইয়াবা কারবার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে ইয়াবা কারবার ছাড়াও টঙ্গী সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক রেজাউল করিমের চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের তথ্য উঠে আসে। সংবাদ প্রকাশের পরই ওই ছাত্রলীগ নেতার বিষয়ে তদন্তে নামে গাজীপুর মহানগর পুলিশ (জিএমপি) ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। ২৮ এপ্রিল রেজাউলকে
গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওইদিন বিকালে তাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
কক্সবাজার থেকে এক লাখ পিস ইয়াবার একটি চালান আনেন রেজাউল। বিক্রির জন্য সেগুলো আরেক মাদক কারবারি শাহিদা আক্তারকে দেন। কিন্তু শাহিদার কাছ থেকে ওই চালান ধরা পড়ে ডিবি পুলিশের হাতে। এ নিয়ে রেজাউল ও শাহিদার মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। প্রায় ২০ মাস পর জেল থেকে ছাড়া পান শাহিদা। জেল থেকে বেরিয়ে ইয়াবা কারবার এবং ইয়াবা বিক্রির টাকার হিসাব নিয়ে মোবাইল ফোনে রেজাউলের সঙ্গে কথা বলেন শাহিদা। দ্বন্দ্বের কারণে রেজাউলের ইয়াবা কারবারের প্রমাণ রাখতে শাহিদা নিজেই তাদের কথোপকথনটি রেকর্ড করে রাখেন। ওই কল রেকর্ডের সূত্র ধরেই তাদের ইয়াবা কারবারের অনেক তথ্য সামনে চলে আসে।
সেই কল রেকর্ড
ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল : ঢাকার ডিবি তো, এই জন্য কিছু করতে পারি নাই। টঙ্গী বা গাজীপুরের ডিবি না। তারা বাইরে থেকে আসছে। আল্লাহর কাছে শুধু আলহামদুল্লিাহ কনÑ আল্লাহ আপনারে রাখছে।
শাহিদা আক্তার : হ, ক্রস (ক্রসফায়ার) দিলে তো আজকে আমার এই কথাডা তোমার শুনতে হইত না।
রেজাউল : জুলফিকার (এসআই জুলফিকারুল ইসলাম) আমারে কয়, আপনি তো সরকারি দল করেন। আপনি আমাদের টার্গেট না। আমাদের টার্গেট কক্সবাজার পার্টি। তাই আমাদের ৫০ লাখ দেন, আপনার নামটা মামলায় দিব না। না দিলে ৫০ হাজার ইয়াবাসহ আপনার (শাহিদা) নামে মামলা দেবে এবং আমারে আসামি করবে বলে জানায়। পরে ২০ লাখে ফিক্সড হয়। তয় আমি কই, আমার নাম বাদ দিতে হইব এবং শাহিদা কাকিরেও ছাইড়া দিতে হইব। আমার বউ (মেহেরুন নেছা) প্রথমে মহাখালী গিয়ে এসআই জুলফিকারের হাতে ১০ লাখ টাকা দিয়ে আসে। পরে আরও ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু পরে শুনি আপনারে আর ছাড়ে নাই। জানতে চাইলে জুলফিকার আমারে কয়, বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেছে, তাই চালান দিতে হইছে। তবে ইয়াবা দিছি (এজাহারে) মাত্র ১০ হাজার।
শাহিদা : ৪৯টি প্যাকেটে এক লাখ ইয়াবা ছিল। সবই লইয়া গেছে তারা। ইয়াবাসহ আমারে মিন্টু রোডে নিয়া যায়। পরে আমারে কয় দুই কোটি টাকা দিলে ছাইড়া দিব। আমি কই, এত টেকা পামু কই? পরে দুই বারে ৩২ লাখ উনি (শাহিদার স্বামী তাজুল ইসলাম তাজু) ডিবিরে দিয়ে আসে। কিন্তু আমারে হেরা ছাড়ল না। চালান কইরা দিল।
ডিবির অভিযান হয়েছিল টঙ্গীতে
শাহিদা আক্তারের বাসা টঙ্গী মধ্যপাড়ার মরকুন এলাকায়। ২০১৯ সালের ২ মার্চ ওই বাসায় ডিবি পুলিশের অভিযান দেখেছেন এমন স্থানীয় দুজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, সন্ধ্যার পরপরই ওই বাসায় ডিবি পুলিশ অভিযান চালায়। খবর শুনে মানুষ জমে যায় সেখানে। ডিবি পুলিশ ঢাকার না গাজীপুরের সেটি তারা জানেন না। তবে এই ঘটনার ছায়া তদন্তে থাকা একটি সংস্থার এক কর্মকর্তা অভিযানটি টঙ্গীর ওই বাসায় হওয়ার বিষয়টি এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।
ডিবি পুলিশকে টাকা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শাহেদার স্বামী তাজুল ইসলাম বলেন, সবকিছু তো রেকর্ডেই আছে। আবার আমারে জিগান ক্যা? হেরা বাসা থেকে তারে ধইরা নেওয়ার সময় বাসার মাল জিনিস ভাইঙ্গা থুইয়া যায়। ডিবির এসআই জুলফিকারুল ইসলামের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়ার কথা ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল করিমের স্ত্রী মেহেরুন নেছাও নিশ্চিত করেছেন।
ডিবির এজাহারের বর্ণনা এবং বাস্তবতা
ডিবির এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, অভিযানে অংশ নেওয়া নারী কনস্টেবল খাদিজা পারভিন ছাড়াও আরও দুই ব্যক্তিকে মামলায় সাক্ষী করা হয়। কিন্তু পুলিশ সদস্যের বাইরের দুই সাক্ষীর একজন টাকার বিনিময়ে সাক্ষী দেন। তাকে ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে যেভাবে সাক্ষী দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল তিনি সেভাবেই সাক্ষী দেন। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি।
অন্যদিকে, আমাদের সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে তদন্তে নামে গাজীপুর মহানগর পুলিশ (জিএমপি)। তাদের তদন্তেও বেরিয়ে এসেছে রেজাউল ও শাহিদার ইয়াবা কারবারের বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ। তবে কৌশলগত কারণে বিষয়টি নিয়ে এখনই সবকিছু বলতে নারাজ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে জিএমপি দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ ইলতুৎমিশ আমাদের সময়কে বলেন, কল রেকর্ডটি আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। কল রেকর্ডটি সঠিক।
যা বললেন কর্মকর্তারা
ডিবির তেজগাঁও জোনাল টিমের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (এসি) শিবলী নোমান বর্তমানে ভিভিআইপিদের নিরাপত্তায় গঠিত পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়নে (এসপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত। অভিযোগের বিষয়ে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, যেখানে অভিযান হয়েছে এবং ইয়াবা যত পিস ছিল ঠিক সেটাই এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। এসআই জুলফিকার টাকা নিলে তো আসামি ছেড়ে দেওয়ার কথা। তাই না? আসামি তো ২০ মাসের মতো জেল খেটেছে। এখন এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কেন? মামলার সাক্ষীর বিষয়ে তিনি বলেন, সাক্ষীর বিষয়টি আমি বলতে পারব না। মামলার বাদী ভালো বলতে পারবে।
সাক্ষীর বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী ও ডিবির তৎকালীন (বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলা পুলিশে কর্মরত) এসআই শাহাব উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, আসলে অনেক আগের ঘটনা, নথিপত্র দেখে বলতে হবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877