স্বদেশ ডেস্ক:
নানামুখী চাপে বেকায়দায় পড়েছে হেফাজতে ইসলাম। কেন্দ্রীয় যুগ্মমহাসচিব ও ঢাকা মহানগরী সাধারণ সম্পাদক মামুনুল হকের সোনারগাঁওয়ের রিসোর্ট কাণ্ডে সমালোচনার মুখে পড়া কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকসহ নেতাকর্মী গ্রেফতার, মাদরাসা বন্ধ করে দেয়া এবং সর্বশেষ সাবেক আমির আল্লামা শফীকে ‘হত্যার’ অভিযোগে বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরীসহ ৪৩ জনকে অভিযুক্ত করে পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে হেফাজত। তবে এসব ঘটনায় নেতকর্মীরা চুপ করে বসে থাকবে না বলে সতর্ক করেছে হেফাজত। হেফাজত আমির জানিয়েছেন, নেতাকর্মীদের ওপর এভাবে জুলুম চলতে থাকলে আমরা নিশ্চুপ ঘরে বসে থাকব না। দেশবাসীকে সাথে নিয়ে শান্তিপূর্ণ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হবো।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় আগমনের প্রতিবাদে গত ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ ঢাকা, চট্টগ্রাম, বাহ্মহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের সাথে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও সরকারি দলের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় হেফাজতের ২০ জনের মতো কর্মী-সমর্থক নিহত, অনেক নেতাকর্মী আহত ও বেশকিছু নেতাকর্মী গ্রেফতারের শিকার হয়। এরপরই নারায়ণগঞ্জে যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হকের রিসোর্ট কাণ্ড ঘটে। সেখানে মামুনুল হককে হেনস্তা ও পরে তাকে উদ্ধারে হেফাজত কর্মীদের হাতে রিসোর্ট ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। মামুনুল হকসহ হেফাজত নেতারা তার সাথে থাকা মহিলাকে বৈধ স্ত্রী দাবি করলেও সরকারের পক্ষ থেকে সে দাবি নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামুনুল হক ও তার স্ত্রীর বেশকিছু ফোন কল ফাঁস হওয়ায় ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন ঘটনা জনসমক্ষে চলে আসে। এতে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়েছে হেফাজত। যদিও মামুনুল হকের পক্ষ থেকে এসব ঘটনাকে পরিকল্পিত অপপ্রচার বলে দাবি করা হয়েছে।
এ দিকে এসব ঘটনার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নেতাকর্মী গ্রেফতারের মুখে পড়েছে হেফাজত। গত রোববার হাটহাজারিতে বৈঠক থেকে ফেরার পথে হেফাজতের কেন্দ্রীয় সহ-অর্থ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগরের সহসভাপতি মুফতি ইলিয়াস হামিদিকে আটক করে র্যাব। একই সময় হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীও নিখোঁজ হয়ে যান বলে হেফাজত নেতারা প্রচার করতে থাকেন। তবে গতকাল পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাকে আটক করা হয়েছে। তাকে আটকের পর ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। সেখান থেকে ২০১৩ সালের ৬ মে পল্টন থানায় করা এক মামলায় আটক দেখিয়ে পুলিশ তার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। আদালত শুনানি শেষে তার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এ ছাড়া ঢাকার জুরাইন থেকে হেফাজতের আরেক নেতা মাওলানা ইকবাল হোসাইনও আটক হয়েছেন।
এ দিকে করোনার কারণে সরকার কওমি মাদরাসাসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। এতেও খানিকটা বেকায়দায় পড়েছে মাদরাসাকেন্দ্রিক এ সংগঠনটি। রমজানের এ সময়ে মাদাসাকেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সমস্যায় পড়েছে হেফাজত। এজন্য গত রোববারের বৈঠক থেকে হেফাজতের নেতারা কওমি মাদরাসা বন্ধ না করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বাবুনগরীসহ ৪৩ জনকে অভিযুক্ত করে পিবিআইর প্রতিবেদন : হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমির শাহ আহমদ শফীকে হত্যার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরীসহ ৪৩ জনকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গতকাল সোমবার বিকেলে চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এটি জমা দেয়ার বিষয় নিশ্চিত করেন পিবিআই ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে ৪৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। নরহত্যার দায়ে দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় প্রতিবেদনটি দেয়া হয়েছে। পিবিআই সূত্র জানায়, প্রতিবেদনে জুনায়েদ বাবুনগরী ছাড়াও সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস, সহকারী মহাসচিব হাবিব উল্লাহ, হেফাজত নেতা নাছির উদ্দিন মুনির, আহসান উল্লাহ, জাকারিয়া নোমান ফয়েজী, আবদুল মতিন, শহীদুল্লাহ, রিজুয়ান আরমান, জাফর আহমদ, এনামুল হাসান ফারুকী, আনোয়ার শাহ, শফিউল আলমসহ ৪৩ জন রয়েছেন।
নেতাকর্মীদের মুক্তি দাবি হেফাজত আমিরের : গতকাল এক বিবৃতিতে সারা দেশে গ্রেফতার হওয়া হেফাজত নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছেন হেফাজত আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। তিনি বলেন, আটককৃত হেফাজতের সব নেতাকর্মীকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। নিরপরাধ মানুষকে এভাবে গ্রেফতার ও হামলা-মামলা বরদাশত করা হবে না। তিনি আরো বলেন, কিছুদিন আগে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীদের শহীদ করেছে, রক্তাক্ত করেছে।
এরপরও দেশের বিভিন্ন জায়গায় একের পর মিথ্যা মামলা করা হচ্ছে হেফাজত নেতাকর্মীদের নামে। এত জুলুমের পরও হেফাজতে ইসলাম অত্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। সরকার প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হেফাজতে ইসলামের সরলতাকে দুর্বলতা মনে করলে এর চরম মাশুল দিতে হবে। হেফাজতে ইসলাম দেশে শান্তি শৃঙ্খলা চায়। তবে জুলুমবাজদের জুলুমে পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে দেশবাসীকে সাথে নিয়ে সমুচিত জবাব দেয়া হবে। হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, আমাদের কাছে খবর এসেছে, গভীর রাতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হেফাজত নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। হেফাজতে ইসলাম দেশে নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস চায় না। হেফাজত ইসলাম শান্তি চায়। হেফাজতে ইসলাম একটি সুশৃঙ্খল ও শান্তিপ্রিয় সংগঠন। তবে নেতাকর্মীদের ওপর এভাবে জুলুম চলতে থাকলে আমরা নিশ্চুপ ঘরে বসে থাকব না। দেশবাসীকে সাথে নিয়ে শান্তিপূর্ণ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হবো।
হেফাজত মহাসচিব : হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব, ঢাকা খিলগাঁও মাখযানুল উলুম মাদরাসার মহাপরিচালক ও আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশের আমির আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদী গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দিয়ে হেফাজত নেতৃবৃন্দকে এভাবে গ্রেফতার ও গুম করার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার হওয়া সব নেতাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। হেফাজত মহাসচিব আরো বলেন, আসন্ন রমজান মাস। রহমত, বরকত ও নাজাতের মাস। এ মাসকে সামনে রেখে উলামায়ে কেরামকে গ্রেফতার ও হয়রানি কোনোভাবে সহ্য করা যায় না। দেশের তৌহিদি জনতা এসব সহ্য করবে না। নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা মামলা বন্ধ না হলে দেশের সর্বস্তরের জনগণ এ জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হবে। তিনি বলেন, রাতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর এভাবে হয়রানি ও মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হলে আমরা নিশ্চুপ বসে থাকব না। এভাবে চলতে থাকলে পরামর্শক্রমে হেফাজতে ইসলাম কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।
খেলাফত মজলিস : নারায়ণগঞ্জের মদনপুর থেকে আটক হওয়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগরীর সহসভাপতি মুফতি ইলিয়াস হামিদি, ঢাকার জুরাইন থেকে আটক হওয়া নারায়ণগঞ্জ জেলা সহসভাপতি মাওলানা ইকবাল হোসাইনসহ সারা দেশে গ্রেফতার হওয়া আলেম-উলামা ও সাধারণ জনগণের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির শায়খুল হাদিস আল্লামা ইসমাঈল নূরপুরী, মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হকসহ নেতৃবৃন্দ। এক বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, সারা দেশে দিন দিন করোনা মহামারী বেড়েই চলছে। মানুষ মহা আতঙ্কগ্রস্ত। এর মাঝে বিভিন্ন জায়গায় মসজিদ, মাদরাসা ও বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আলেম-উলামা ও সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। এটা দেশ ও জাতির জন্য বিপদ ডেকে আনবে। আল্লাহকে ভয় করুন। আলেম-উলামা ও নিরীহ সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও গ্রেফতার বন্ধ করুন এবং গ্রেফতারকৃতদের নিঃশর্ত মুক্তি দিন।
নেজামে ইসলাম পার্টি : হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নেজামে ইসলাম পার্টির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, ঢাকা মহানগর হেফাজতের সহসভাপতি মাওলানা ইলিয়াস হামিদী এবং মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানীসহ গ্রেফতারকৃত সব নেতাকর্মীকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। গতকাল এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির আমির আল্লামা সরওয়ার কামাল আজিজি এবং পার্টির মহাসচিব আল্লামা মুসা বিন ইজহার এ দাবি জানান।