আহমেদ জামিল: সম্প্রতি দেশে ধর্ষণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই আসচ্ছে নারীর প্রতি নৃশংসতার একাধিক খবর। পশুত্বের এই বিষাক্ত দৃষ্টি থেকে বাদ যায়নি অবুঝ শিশু, প্রতিবন্ধী থেকে ষাটোর্ধ্ব নারীও। ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণই শেষ নয়, ধর্ষণের পর খুন করা হচ্ছে নৃশংসভাবে। পরিস্থিতি এতটাই সর্বব্যাপী যে, সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে নারীরা রয়েছেন নিরাপত্তাহীনতায়।
মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ‘অধিকারের’ দেয়া তথ্যমতে, ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৩ হাজার ৬৩৮টি, যার ভেতরে গণধর্ষণ ছিল দুই হাজার ৫২৯টি। এই সময়ে ৬ হাজার ৯২৭ জন শিশুকে ধর্ষণ করা হয় ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ১ হাজার ৪৬৭ জনকে। ধর্ষণের গ্লানি সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন ১৫৪ জন। পরিসংখ্যান মতে, ২০০৮ সালে ধর্ষণের শিকার ৩০৭ জন, ২০০৯ সালে ৩৯৩, ২০১০ সালে ৫৯৩, ২০১১ সালে ৬৩৫ , ২০১২ সালে ৫০৮, ২০১৩ সালে ৫১৬ জন, ২০১৪ সালে ৫৪৪, ২০১৫ সালে ৮০৮, ২০১৬ সালে ৬৫৯, ২০১৭ সালে ৮১৮, ২০১৮ সালে ৩৫৬ ধর্ষণের শিকার হয়। ছাড়া ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণচেষ্টা ও নির্যাতনের ফলে আক্রান্ত হয়েছে ১০০৬ শিশু। ২০১৯ সালের ১৫ মে পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার ৪১৯ জন। এর মধ্যে ২৯৬ জনই শিশু।
এ ছাড়া লোকলজ্জার ভয়ে আরও হাজারো নৃশংসতার খবর মিডিয়ায় আসছে না, আবার থানা পুলিশ করছেন না অনেকে। যে কারণে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে শিশু ও নারীর প্রতি পাশবিকতা, নৃশংসতা।
মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই: মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয় শিক্ষক সমাজকে। একজন শিক্ষককে মর্যদার শীর্ষস্থানে রাখা হয়। অথচ আজ এই পিতৃত্যুল অনেক শিক্ষকের কাছে নিরাপধ নয়, তাদের সন্তানত্যুল মেয়েরা। কতটুকু নৈতিক অবক্ষয় হলে আজ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষককের কাছে অনিরাপধ ছাত্রীরা নিরাপদ বোধ করছে না। এই নৈতিক অবক্ষয়ের শেষ কোথায়?
কুষ্টিয়ায় আলোচিত স্কুল শিক্ষক হেলাল উদ্দিন ওরফে পান্না মাস্টার, ভিকারুননেসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিমল, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের ইংরেজি ভার্সনের হুমায়ুন কবির, সর্বশেষ আলোচনায় এসেছে নারায়ণগঞ্জের লম্পট আরিফুল ইসলাম। যে পাঁচ বছরে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির অন্তত ২০ শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করেছে। শুধু শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে ক্ষান্ত হয়নি, ফাঁদে ফেলে শিক্ষার্থীর মাকেও ধর্ষণ করেছে। লম্পট এই শিক্ষকরা কখনো পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়া বা ফেল করিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো। আবার কখনো ছাত্রীদের বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেল করে এসব কুকর্ম করে আসছে। এরা মূলত শিক্ষক নামের কলঙ্ক। শতাধিক ছাত্রীকে ধর্ষণ এবং পর্নোগ্রাফি মামলায় পান্না মাস্টারকে মাত্র ১০ বছর কারাদ- দিয়েছেন আদালত। এ ধরনের একটি অনৈতিক কর্মকা- করেও যখন অপরাধী শাস্তি পায় না, তখন অনায়েশে মানুষের মাঝে অপরাধ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
এই পশুবৃত্তিটাই এখন নিরাপদ ঘরের মধ্যে হচ্ছে। মা-মেয়ে এক সাথে ধর্ষিত হচ্ছে স্কুলে ধর্ষিত হচ্ছে। মাদ্রাসায় ধর্ষিত হচ্ছে। কলেজে ধর্ষিত হচ্ছে। বাসে ধর্ষিত হচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে মিডিয়ার আড়াল হলেই অপরাধ করে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। তাতে অপরাধ করার প্রবণতা আরও বাড়ছে। দেখা গেছে, ধর্ষণের অনেক ঘটনায় সামাজিক সম্মানের কারণে এবং দীর্ঘমেয়াদি বিচার ব্যবস্থার কারণে ভুক্তভোগীরা এ মুখী হচ্ছে না। এখনি যদি এই ভয়াবহতার রেশ টেনে ধরা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভেবে কূল পাচ্ছে না অভিভাবক মহল ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সময়ের দাবি: নানা ধরনের প্রভাব ও রাজনৈতিক অপ্রত্যাশিত চাপের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই বিচার পাওয়া যায় না। বিচার পেতে অপেক্ষা করতে হয় যুগের পর যুগ। অথচ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণে অপরাধের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আইন ভঙ্গকারীদের দোষী সাব্যস্ত ও তা যাচাইয়ের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। আধুনিক যুগে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অভ্যন্তরে শাস্তির যে বিধান প্রচলিত তা ক. প্রতিশোধমূলক; খ. প্রতিরোধমূলক, গ. সংশোধনমূলক শাস্তি। এ তিনটির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে আধুনিক শাস্তি তত্ত্ব ও বিধান। প্রতিরোধমূলক শাস্তি তত্ত্বের মূল কথা হলো অপরাধের শাস্তির মাধ্যমে তার পুনরাবৃত্তি না হওয়া নিশ্চিত করা। মধ্যযুগে এ তত্ত্বের ভিত্তিতে অপরাধীর শাস্তি হিসেবে তার হাত অথবা পা কর্তন কিংবা পঙ্গু করার বিধান ছিল।
বর্তমান সময়ে দেশের চলমান নৃশংসতার ঘটনায় প্রতিরোধমূলক শাস্তি বিধান রেখে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করা সময়ের দাবি। বাংলাদেশে এখন প্রয়োজন ভারতের একটি উচ্চ আদালত যেভাবে ধর্ষণের দায়ে পুরুষাঙ্গ কর্তনের রায় দিয়েছে অথবা সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা অঙ্গরাজ্যে শিশু ধর্ষণ রুখতে নতুন এক আইন পাস করেছে। এই আইন অনুযায়ী, ১৩ বছরের কম বয়সী কোনো মেয়েকে ধর্ষণ করলে ধর্ষককে ইনজেকশন দিয়ে বা ওষুধের মাধ্যমে নপুংসক করে দেওয়া হবে। তা প্রতিরোধমূলক শাস্তির বিধান রেখেই করা হয়েছে। এ ছাড়া সৌদি আরব ও চীনে ধর্ষণের শাস্তিস্বরূপ শিরñেদ ও খোঁজাকরণ (পুরুষাঙ্গ কর্তন) এ শাস্তি তত্ত্বের উদাহরণ রয়েছে। এতে ওই ধর্ষককে দেখে অন্য পশুরাও কোনো নৃশংসতা ঘটানোর সাহস পাবে না। বরং হিজড়া হয়ে সমাজে বসবাস করবে।
প্রতিরোধমূলক শাস্তি তত্ত্ব নিয়ে প্রচলিত একটি গল্পে বিচারক বলেন, ‘আমি তোমাকে ভেড়াটি চুরি করার জন্যে শাস্তি দিচ্ছি না। আমি তোমাকে শাস্তি দিচ্ছি, যেন মানুষ ভবিষ্যতে ভেড়া চুরি না করে।’ শাস্তির মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব। আর তাই যেকোনো ধরনের শাস্তির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ন্যায়, শান্তি, সামাজিক স্থিতি ও অপরাধীর অপরাধ করার মানসিকতার পরিবর্তন।
এ বিষয়গুলো সামনে আনার মূল কারণ দেশে যেভাবে ভয়াবহ হারে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, তাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত এ দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। ধর্ষিতা শিশুকন্যার অসহায় বাবা মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের তলায় আত্মাহুতি আর কত? এখন প্রশ্ন হলো, মানব কল্যাণের জন্য যে তিনটি উপাদান (আইন, ধর্ম ও নৈতিকতা) রয়েছে, তার কয়কটিকে গ্রহণ করা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অপরিহার্য? আইন, ধর্ম ও নৈতিকতাÑ এই তিনটি উপাদানই মানুষের জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়। তবে আইন পালন করা সকল ব্যক্তি-মানুষের জন্য ব্যাধ্যতামূলক- সকল গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক রাষ্ট্রে। এখানে আইন লংঘনে ব্যক্তি-মানুষকে শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করানো প্রয়োজন।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক কারণে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। অনেক দেশে কিন্তু দ্রুত বিচার আইনে সাজা হয এবং মানুষ তা দেখে সচেতন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয় খুবই ধীরগতিতে। ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেশত্যাগ করে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিতে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সময়ের দাবি।