রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:২৩ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
‘দিনের পর দিন অনির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ চালাতে দিতে পারি না’ ট্রাইব্যুনালে প্রধান অভিযুক্তদের বিচার এক বছরের মধ্যে শেষ হবে : চিফ প্রসিকিউটর সাদপন্থী জিয়া বিন কাসিম গ্রেফতার গণহত্যার বিচার করাই আমার প্রধান দায়িত্ব: আসিফ নজরুল সচিবালয়ে সাংবাদিক প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা সাময়িক: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিবালয়ে আগুন গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ: রিজভী এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজায় বাসের ধাক্কা, নিহত বেড়ে ৬ ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের প্রতিবাদ আইএসপিআরের ইতিহাস গড়লো নাসা, সূর্যের কাছাকাছি মহাকাশযান এক দিনের ব্যবধানে সিলেটে ‘ভারতীয় খা‌সিয়াদের গু‌লিতে’ আরেকজন নিহত
দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরিই সংস্কারের প্রথম চ্যালেঞ্জ

দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরিই সংস্কারের প্রথম চ্যালেঞ্জ

স্বদেশ ডেস্ক:

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন খাত ও ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব তৈরিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ১১টি কমিশনের মধ্যে প্রথমে গঠিত ৬টি কমিশনের এ মাসের শেষে এবং আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝিতে পর্যায়ক্রমে তাদের সংস্কার প্রস্তাব জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। বাকি ৫টি কমিশন ফেব্রুয়ারিতে তাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো জমা দিতে পারবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সংস্কার কমিশনগুলো বেশ কিছু নতুন প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কারে বড়সড় পরিবর্তন আনার কথা ভাবা হচ্ছে।

তবে সংস্কার প্রস্তাব জমা দেওয়ার আগেই অন্তর্বর্তী সরকার জনপ্রশাসন, নির্বাচন কমিশন (ইসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বিচার বিভাগের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সেই পুরনো ধারায়, যা সংস্কারের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। আবার সংস্কার কমিশনের সম্ভাব্য প্রস্তাব নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে। বিশেষ করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রস্তাব ঘিরে পুরো প্রশাসনযন্ত্র উত্তাল হয়ে উঠেছে। ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন প্রশাসনের প্রভাবশালী প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এমনকি তারা খোদ কমিশনপ্রধান ড. আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর অপসারণ দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন। এ ছাড়া পুনর্গঠনের আগে এই কমিশনের কোনো সুপারিশ জমা দেওয়ার দরকার নেই বলেও উল্লেখ করেছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বাসা) নেতারা। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে ক্যাডার সার্ভিস থেকে আলাদা করার প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ অন্য ক্যাডার সংগঠনগুলোও।

যদিও এর আগে বিভিন্ন সময়ে কোনো খাতে সংস্কারের ক্ষেত্রে দেখা গেছে সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশ জমা দেওয়ার পর তা বাস্তবায়নে কমিটি গঠন করে সরকার। তখন সেসব সুপারিশ নিয়ে সমালোচনা বা বিতর্ক তৈরি হয়। কিন্তু এবার ঘটছে উল্টোটা। সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে তাদের প্রস্তাব জমা দেওয়ার আগেই তা জানাজানি হয়ে যাচ্ছে বা কমিশনের পক্ষ থেকেই সম্ভাব্য সুপারিশের বিষয়গুলো জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

সংবিধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কারও কারও পরামর্শ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারই সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করবে, তারপর জাতীয় নির্বাচন। আবার অনেক রাজনীতিবিদসহ কারও কারও মত, সংস্কার প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে দিলে তারা তা সংসদে অনুমোদন করবে। বিশেষ করে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সংসদের বাইরে সংবিধান পরিবর্তনের বিরুদ্ধে। একই ধরনের মতামত এসেছে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা বলছেন, সংস্কারের প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি করা। কমিশন সুপারিশ জমা দিলে অন্তর্বর্তী সরকার তা সরাসরি বাস্তবায়ন শুরু করতে পারবে না। কারণ তাতে প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়তে হতে পারে। সংস্কার প্রস্তাব হাতে এলেও শেষ পর্যন্ত সংস্কার কোন কোন খাতে, কীভাবে হবে তা নিয়ে সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসতে হবে। আবার সংস্কার ব্যাপকভাবে হবে নাকি স্বল্প পরিসরে হবে সেটা নিয়েও দলগুলোর সঙ্গে সরকারকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। গত ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া ভাষণেও এ দোলাচলের চিত্র ফুটে উঠেছে। সেদিন প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, তিনি প্রধান সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে বারবার আবেদন জানিয়ে আসছেন।

কমিশনগুলোর সদস্যরা জানিয়েছেন, সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করতে সংবিধান, আইনবিধি পর্যালোচনার পাশাপাশি ডিজিটাল মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া এবং অংশীজনদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময় করছেন তারা। উন্নত বিশ্বের কার্যক্রম পর্যালোচনার পাশাপাশি লিখিত মতামত নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকেও। সেই সঙ্গে জনমত জরিপ চালানো এবং ঢাকার বাইরে কয়েকটি বিভাগীয় শহরেও নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে কয়েকটি সংস্কার কমিশন। এরই মধ্যে সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে সুপারিশ লেখার কাজও শুরু হয়েছে।

কিছু শঙ্কা ও সমালোচনা : নাগরিকদের জন্য অনলাইনে সংস্কার বিষয়ে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত জানানোর ব্যবস্থা রাখা হলেও, বাস্তবে খুব অল্পসংখ্যক মানুষকেই সেখানে মতামত দিতে দেখা গেছে। সাধারণ মানুষদের অনেকেই বলেছেন, তারা এ মতামত দেওয়ার বিষয়ে অবগত নন। ফলে সাধারণ মানুষের মতামত কতটা প্রাধান্য পাবে সেটিও প্রশ্ন উঠেছে।

এদিকে সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলো সংস্কার প্রস্তাব জমা দেওয়ার আগেই পুরনো আইনে পাঁচ বছরের জন্য গঠন করা হয়েছে নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের প্রথম ধাপ নির্বাচন কমিশন গঠনের পদ্ধতি ঠিক করা। কিন্তু নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব জমা দেওয়ার আগেই ২০২২ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা বিতর্কিত আইনে নতুন ইসি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে সংশ্লিষ্ট সংস্কার কমিশনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন সংস্কারে কমিশন ইতিমধ্যে একটি খসড়াও তৈরি করেছে। কিন্তু সরকার নতুন ইসি গঠনে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। ইতিমধ্যে পুরনো প্রক্রিয়ায় ইসি গঠন করা নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে নতুন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইন ও বিধিমালা সংস্কারে সুপারিশ তৈরিতে কমিটি করেছে। একই কাজ করছে সংস্কার কমিশন। এটি নিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানের মাছউদ বলেছেন, তাদের কমিটি গঠন করা হলেও তারা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করবেন।

৩১ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু তার আগেই চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের আমলের মতোই জনপ্রশাসনে চুক্তিতে নিয়োগ ও রাজনৈতিক পরিচয় যাচাইয়ের পুরনো প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া বা না দেওয়ার চর্চা অব্যাহত রয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দেবে। এরপর সরকার রাজনৈতিক দল এবং অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনে কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে।

সে পর্যন্ত যাওয়ার আগেই জনপ্রশাসনে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে সম্প্রতি কমিশনের প্রধান ও সচিবের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পরপরই বিবৃতি দিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছে প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডার সমিতি এবং আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। ভিন্ন ভিন্ন দাবি হলেও, সবাই এসব সুপারিশকে ‘বৈষম্যমূলক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। বিশেষ করে পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি, পদোন্নতিতে কোটা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডার থেকে আলাদা রাখার ক্ষেত্রে যে ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, তা মানতে নারাজ বিসিএস ক্যাডাররা।

স্বাস্থ্য ক্যাডার বিলুপ্ত করতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করেছে, তা প্রত্যাখ্যান করে ‘বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন’ বলেছে, তাহলে কোনো ক্যাডার সার্ভিসই রাখা যাবে না। তাদের ভাষায় এটি একতরফা সংস্কার প্রস্তাব।

উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য আইন করার কথা থাকলেও কোনো সরকার তা করেনি। অন্তর্বর্তী সরকারও কোনো অধ্যাদেশ করেনি বা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করেনি। পুরনো পদ্ধতিতেই বিচারক নিয়োগ হয়েছে।

একইভাবে দুদক কমিশনার নিয়োগ পদ্ধতি সংস্কারের কথা সংশ্লিষ্টরা বলে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। দুদক সংস্কার কমিশনও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু এর মধ্যে দুদকে নতুন চেয়ারম্যান ও দুজন কমিশনার নিয়োগ হয়েছে। ইসি এবং ও দুদকের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পুরনো পদ্ধতিতে নিয়োগের ফলে সংস্কার প্রক্রিয়া আসলে কতটা সফল হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কারণে সংস্কারের উদ্দেশ্য ব্যাহতের আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি কোনো কোনো সংস্কার কমিশনে অন্তর্বর্তী সরকারের এমন কিছু উদ্যোগ নিয়ে উদ্বেগও আছে।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন : ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন এবং বেশিরভাগ স্থানীয় সরকার নির্বাচনই ছিল বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে দেশে নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অনাস্থা-সংকট ও স্বৈরাচারী প্রথা গড়ে উঠেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এসব কারণে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ খুঁজছে এ-সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন।

এ কমিশন জানিয়েছে, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন পরিবর্তন, প্রবাসীদের ভোটের বিধান চালু, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা, সীমানা নির্ধারণ আইনে পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। পাশাপাশি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা, রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং নির্বাচনী অপরাধ বন্ধে আইনে সংস্কারের মতো বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনকে কীভাবে স্বাধীন করা যায় কিংবা জনগণের কাছে ইসির দায়বদ্ধতা নিয়েও কমিশন আলোচনা করছে।

কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সবার মতামতের ভিত্তিতে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তারা সরকারের কাছে চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাব জমা দিতে পারবেন বলে আশা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যেসব বিষয়ে সংস্কারের কাজ শুরু করেছি সেটি বাস্তবায়ন করা গেলে আগামীতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।’

সংবিধান সংস্কার কমিশন : সংবিধান সংস্কার বিষয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে সারা দেশে জরিপ চালিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এ কমিশন সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পাশাপাশি প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছে। কমিশন কাজ শুরুর পর প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, একজন ব্যক্তিকে দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না রাখা, পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল, আনুপাতিক হারে ভোটের বিধান, দ্বিকক্ষ সংসদ চালু, প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা চালু, সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনাসহ সংবিধানে বেশ কিছু পরিবর্তনের পরামর্শ এসেছে।

সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বাড়ানো-কমানো নিয়ে দুই ধরনের পরামর্শই এসেছে কারও কারও কাছ থেকে। বর্তমানে সংসদ কার্যকর নেই। যে কারণে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো কীভাবে অনুমোদন করা যায় সেটি নিয়েও নানা মতামত আসছে। এ ক্ষেত্রে কারও কারও পরামর্শ গণপরিষদ গঠন করে সংবিধানের অনুমোদন করা। আবার অনেকে বলছেন, সংস্কার প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে দিলে তারা তা সংসদে অনুমোদন করবে।

অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সংসদের বাইরে সংবিধান পরিবর্তনের বিরুদ্ধে। একই ধরনের মতামত এসেছে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও।

সংবিধান সংস্কার কমিশন আশা করছে, আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তারা খসড়া প্রতিবেদন সরকারকে দিতে পারবে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন : বিভিন্ন সরকারের আমলে সরকারি চাকরিজীবীদের আচরণ নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। আবার অনেক সময় সরকারি আমলাদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কিংবা পক্ষপাতিত্ব নিয়ে নানা অভিযোগ উঠলেও সেগুলো বন্ধে কঠোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর গত সাড়ে তিন মাসেও মৌলিক কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি জনপ্রশাসনে। অথচ দেশের প্রান্তিক পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত জনপ্রশাসনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনপ্রশাসন সংস্কারের জন্য গঠিত এ-সংক্রান্ত কমিশন তাদের প্রস্তাব তৈরির লক্ষ্যে অংশীজন ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করছে। এতে জনপ্রশাসনে দুর্নীতি বন্ধে উদ্যোগ, সরকারি চাকরিতে নিয়োগে স্বচ্ছতা, প্রশাসনে বিকেন্দ্রীকরণ এবং বদলি কিংবা পদায়নে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মানার মতো বিষয়গুলো উঠে আসে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যরা বলছেন, প্রশাসনে কাঠামোগত জায়গা থেকে একটি এবং জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে তুলতে আরেকটি এ দুটি সংস্কার সবচেয়ে বেশি জরুরি। কমিশন সব মতামতকে আমলে নিয়ে কাজ করছে। রাজনীতিবিদদের অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার এক ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সেটি বন্ধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়েও ভাবছে সংস্কার কমিশন।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন : দেশি-বিদেশি অংশীজন ও নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময়ের পাশাপাশি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এবং লিখিতভাবে সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়েছে এ-সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন। এসব মতামত ও সুপারিশ থেকে যাচাই-বাছাই করে গ্রহণযোগ্য প্রস্তাবগুলো কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। জানুয়ারির মাঝামাঝিতে সংস্কার প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে তা প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিতে পারবেন বলে কমিশনের সদস্যরা আশা করছেন।

এই কমিশন বিচারপতি ও সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগসহ বিচার বিভাগের বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব করতে যাচ্ছে। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের মধ্যে রয়েছে প্রধান বিচারপতিসহ উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন, রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াই সর্বোচ্চ আদালত এবং জেলা আদালতে সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনায় স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন এবং ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় মামলার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনায় স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠন। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতি নিয়োগের একক ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে রাখার সাংবিধানিক বিধান সংশোধনের প্রস্তাবও করবে কমিশন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতির নিয়োগকে নির্বাহী কর্র্তৃপক্ষের প্রভাবমুক্ত করতে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারককেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করার বিধান চালুর প্রস্তাব দেওয়া হবে।

পুলিশ সংস্কার কমিশন : বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশের নানা কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিষয়টি সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের পুলিশি কাঠামো ঢেলে সাজানোর কথা বলছে। আইনি কাঠামোয় সংস্কার, জবাবদিহি, পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধি, জনকল্যাণমূলক কাজে পুলিশের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং পুলিশের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড রোধে নানা প্রস্তাবনা এসেছে।

এ সংস্কার কমিশন বলছে, বর্তমানে পুলিশ চলছে প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো আইন দিয়ে। যে কারণে পুলিশি কাঠামো ও এ নিয়ে নানা সংকট থেকে গেছে বছরের পর বছর। যে কারণে পুলিশ সংস্কারে নানা প্রস্তাবনার পাশাপাশি পুলিশ আইন সংস্কারেরও সুপারিশ করবে কমিশন।

দুর্নীতি দমন কমিশন : দুদক চেয়ারম্যান এবং কমিশনার পদে দলীয় প্রভাবমুক্ত যোগ্যদের নিয়োগে আইন; পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কার্যকর সহযোগিতার প্রক্রিয়া কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে এ সম্পর্কিত সংস্কার কমিশন। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দিতে পারবেন বলে আশা করছেন কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান।

গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ছয়টি সংস্কার কমিশনের ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এগুলো হলো নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন। ৩ অক্টোবর পাঁচটি কমিশন পূর্ণাঙ্গ করা হয়। আর সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি হয় ৭ অক্টোবর।

পরবর্তী সময়ে ১৭ অক্টোবর আরও চারটি সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। সেগুলো হলো স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন এবং নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। গত ১৮ নভেম্বর এ চারটিসহ মোট পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। অন্যটি হলো স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877