একেএম শামসুদ্দিন:
গত কয়েকদিনে ঢাকার জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত করোনার ভ্যাকসিন দেওয়াকে কেন্দ্র করে বেশকিছু চমকপ্রদ খবর সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমাদের দেশে ভ্যাকসিন দেওয়া চালু হয়েছে এ সংবাদ আশাপ্রদ হলেও এর প্রয়োগের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তা পীড়াদায়ক। দু-একটি ঘটনা বর্ণনা করলে বিষয়টি বোঝা যাবে।
৭ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘নার্সের পরিবর্তে করোনার টিকা দিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান’। শিরোনামের নিচের খবরটি পড়ে আমাদের দেশের কিছু কিছু জনপ্রতিনিধি যে প্রচারবিলাসী তার ঝাঁজ বোঝা যায়। জানা গেছে, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কেন্দ্রে ৭ ফেব্রুয়ারি করোনা টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিজেই সিরিঞ্জ হাতে তিনজনের শরীরে টিকা পুশ করেন।
শুধু তাই নয়, টিকা পুশ করার দৃশ্যটি আবার ভিডিও করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। উপজেলা চেয়ারম্যানের টিকা পুশ করার দৃশ্য দেখে স্বাভাবিক কারণেই সমালোচনা শুরু হয়; কিন্তু আশ্চর্য হলো, সবার সামনে এমন ঘটনা ঘটে গেলেও কুমারখালী উপজেলার একজন সরকারি কর্মকর্তা স্থানীয় সাংবাদিকদের নিঃসংকোচে বলে দিলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান সিরিঞ্জ হাতে ধরে ছিলেন, পুশ করেননি! জানা যায়, এমন কর্মকাণ্ড শুধু উপজেলা চেয়ারম্যানই করেননি; স্থানীয় সংসদ সদস্যও নাকি একজন নার্সের শরীরে করোনা টিকা পুশ করে কুমারখালী উপজেলার টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছেন।
এমন ঘটনা শোনার পর চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রশিক্ষিত নার্সের বদলে একজন জনপ্রতিনিধি কর্তৃক টিকা দেওয়ার বিষয়টি ভয়ানক এবং এমন কাম্যও নয়। কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন বলেন, এমন কাজ তারা কোনোভাবেই করতে পারেন না’। ঘটনার এখানেই শেষ নয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে ঘটেছে আরও একটি অপ্রীতিকর ঘটনা।
৭ ফেব্রুয়ারি সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করতে এসে সংরক্ষিত আসনের একজন মহিলা সংসদ সদস্য টিকা না নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে টিকা নেওয়ার ভাব করেন এবং ছবি তোলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ছবি ছড়িয়ে পড়লে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
গত এক বছর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির পর এ দেশের মানুষের যখন করোনা টিকা নেওয়ার সুযোগ হয়েছে, সেই টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধন করতে গিয়ে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার মাধ্যমে তাদের প্রচারবিলাসিতারই পরিচয় দিয়েছেন।
করোনা টিকাদান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও এর বিপরীত চিত্রও আমরা দেখেছি। কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে টিকা গ্রহণকারীদের লাল গোলাপ দিয়ে টিকা গ্রহণে উৎসাহিত করার খবরও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, স্থানীয় সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহম্মদ নিজ হাতে টিকা নিতে আসা মানুষদের একটি করে গোলাপ ফুল দিয়ে উৎসাহ দিয়েছেন।
হাওড়অধ্যুষিত এ অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রথম থেকেই করোনা টিকা নিয়ে নানাবিধ কুসংস্কারে ভীত ছিল। জানা গেছে, টিকা নিতে আসা কিছু কিছু মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সংসদ সদস্য রেজওয়ানের হাত থেকে গোলাপ পেয়ে তাদের অনেকেই সে দ্বিধা কাটিয়ে টিকা নিয়েছেন। অন্যদের মতো নিজ হাতে টিকা পুশ না করে সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহম্মদ যে উদ্যোগটি নিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তার এ অভিনব উদ্যোগ এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
করোনার প্রাদুর্ভাবে মানুষ এমনিতেই আতঙ্কগ্রস্ত। তার ওপর আমাদের দেশে আমদানিকৃত ভ্যাকসিনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও মানুষের মনে এক ধরনের সংশয় আছে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে সংসদ সদস্য রেজওয়ান যে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা অন্যদের জন্যও অনুকরণীয়।
ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষের এ সংশয় এক কথায় উড়িয়েও দেওয়া যায় না। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিভিন্ন খাতে যে দুর্নীতি হয়েছে, এমনকি করোনা মহামারি শুরুর পরও যেভাবে একের পর এক দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে, তাতে সাধারণ মানুষ মনে করছেন, করোনা ভ্যাকসিন নিয়েও যে দুর্নীতি হবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে? যতদিন না মানুষের এ সন্দেহ দূর করা যাবে, ততদিন ভ্যাকসিনের গুণগত মান নিয়ে মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত থাকবেই।
ইতঃপূর্বে ভ্যাকসিন আমদানি নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল, সে বিতর্কও সাধারণ মানুষের সংশয়কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলো, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আন্তরিকতা নিয়ে এ দেশের মানুষের একটি বড় অংশের সংশয় আছে। তিস্তা ও গঙ্গার পানিবণ্টন এবং রোহিঙ্গাসহ কিছ কিছু অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে ভারতের অসহযোগিতার মনোভাবে বাংলদেশের জনগণ যে বেশ অসন্তুষ্ট তা নতুন করে বলার কিছু নেই।
এসব কিছু মিলিয়েই হয়তো ভারতের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সিরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত অ্যাস্ট্রাজেনেকা আর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিনের গুণগত মান নিয়েও এ দেশের মানুষের আস্থার অভাব দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া অন্য কারণও আছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতে সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি করোনার টিকা দেওয়ার পর টিকা গ্রহণকারী অনেক মানুষের শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল।
টিকা নেওয়ার পর দুজনের মৃত্যুর সংবাদ যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়েছিল। ভারত সরকার অবশ্য টিকার কারণে তাদের মৃত্যু হয়নি বলে জানিয়েছে। এসব ঘটনায়ও প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের মনে সন্দেহের দানা বেঁধেছিল। এখন অবশ্য কমেছে; তবে এ সন্দেহ বা দ্বিধা যে একেবারে দূর হয়ে গেছে তা বলা যাবে না।
ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের সন্দেহ নিয়ে দোষারোপ করে লাভ নেই। ইউরোপের ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে মানুষের প্রতিক্রিয়াও একই রকম। বিশ্বের যেসব দেশে করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে, সেসব দেশেও ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের সংশয় ছিল। ধীরে ধীরে তা দূর হয়েছে। আমাদের দেশে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরুর পর এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর শুনিনি। প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের ভেতর যে ভয় কাজ করেছিল এখন অবশ্য সে ভয় কাটতে শুরু করেছে।
তবে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ ভ্যাকসিনের সরবরাহ বাংলাদেশ পেয়েছে তা দিয়ে কতজন মানুষকে ডাবল ডোজ দেওয়া যাবে তা দেখতে হবে। সিরাম ইনস্টিটিউট চুক্তি মোতাবেক আমাদের চাহিদা অনুসারে অব্যাহতভাবে টিকার সরবরাহ চালু রাখবে কিনা নিশ্চিত করতে হবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কর্মতৎপরতার ওপর ভবিষ্যতে নিরবচ্ছিন্ন ভ্যাকসিনপ্রাপ্তি নির্ভর করবে।
করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। আমলাতন্ত্র যে অনেক মহৎ কাজের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তার অনেক উদাহরণ আমাদের আছে। করোনাকালে এমন অনেক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি আমরা। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আরও একটি ছোট্ট ঘটনা এ তালিকায় সংযোজিত হয়েছে। ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় একটি মহৎ কাজে আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের অবহেলাজনিত খবর প্রকাশিত হয়েছে।
জানা গেছে, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি, কলেজ, লন্ডন হসপিটালের ও ইংল্যান্ড প্রবাসী কয়েকজন বাংলাদেশি ৫০ হাজার পাউন্ডের একটি তহবিল গড়ে করোনা রোগীদের শ্বাসকষ্টের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ধরনের যন্ত্র ক্রয় করে চার মাসেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় ধরনা দিয়েছে; কিন্তু যন্ত্রটি বাংলাদেশে পাঠাতে পারেননি। অভিযোগ, আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা নাকি প্রবাসী বাঙালিদের মেসেজের জবাব দেওয়ার সময়ও পাননি।
দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর সেই তহবিলের অর্থে কেনা চিকিৎসাযন্ত্র তারা উগান্ডা ও ফিলিস্তিনে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঘটনাটি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। চিকিৎসাযন্ত্রটির মূল্য হয়তো খুব বেশি নয়; কিন্তু দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগটি ছিল মহৎ।
অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, আমাদের দেশে বিনা পয়সার জিনিসের প্রতি দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আগ্রহ কম। কিন্তু যেখানে বিপুল অর্থের লেনদেন রয়েছে, সেখানে কিন্তু তাদের আগ্রহ থাকে অপরিসীম। এমন কেন হয় এর ব্যাখ্যা হয়তো তারাই দিতে পারবেন।
যে কথা বলছিলাম, ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়ে এ দেশের মানুষের সংশয় এখন ধীরে ধীরে অনেক কেটে যাচ্ছে। একটি কথা মনে রাখা দরকার, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সঠিক তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৬৪ শতাংশের বেশি মানুষ করোনার টিকা নিতে আগ্রহী। ভ্যাকসিন সম্পর্কে সঠিক তথ্য পৌঁছানো ও টিকাদানে আস্থাশীল ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া গেলে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পাবে।
এ লেখা যখন লিখছি, তখন এমন অনেকের কাছ থেকে আমি টেলিফোন কল পেয়েছি, যারা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়ে ফেলেছেন অথবা টিকা নেওয়ার তারিখ পেয়েছেন। আমরা আশা করি, কর্তৃপক্ষ ভ্যাকসিনের অব্যাহত প্রাপ্তি সহজলভ্য করে মানুষের আশার আলোকবর্তিকাটিকে প্রজ্বলিত রাখার চেষ্টা করবেন। একইসঙ্গে যেন লক্ষ রাখেন, সুযোগসন্ধানী ও প্রচারমুখী মানুষ যেন ফটোসেশনের আনুষ্ঠানিকতায় টিকাদান কার্যক্রমকে ‘ভ্যাকসিন উৎসবে’ পরিণত না করে।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা