বিএনপির শীর্ষ নেতারা কিছু দিন ধরেই বলছেন, তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন। আসলে দ্রুতই কি দেশে ফিরছেন তিনি? দলের অভ্যন্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দেশে ফেরার তারিখ এখনো সুনির্দিষ্ট হয়নি। তার দেশে ফেরার ইস্যুটির একদিকে যেমন আইনি দিক রয়েছে, অন্যদিকে এটি রাজনৈতিক বিষয় বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বেকসুর খালাস পাওয়ার পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরছেন তা নিয়ে বিএনপির সর্বস্তরে নানান ধরনের জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। দলটির নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘লিডার আসছে’, এ ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। আসলে তিনি ঠিক কবে ফিরবেন, সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত কোনো দিনক্ষণ পাওয়া যায়নি। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যে পাঁচটি মামলায় সাজা হয়, তার মধ্যে একটিতে তিনি খালাস পেয়েছেন। বাকি চারটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। দ্রুততম সময়ে এসব মামলায় খালাস পেলে আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি নাগাদ তিনি দেশে ফিরতে পারেন বলে বিএনপিতে আলোচনা রয়েছে।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানি, নাশকতা, গ্রেনেড হামলা ও দুর্নীতির অভিযোগে ঢাকাসহ দেশব্যাপী ৮০/৮২টির মতো মামলা দায়ের করা হয়। ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এসব মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৭টি মামলা হয়। তারেক রহমানের মামলাগুলোর মধ্যে ৬২টির মতো মানহানির মামলা বলে জানান তার আইনজীবীরা।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও তারেক রহমানের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল এ বিষয়ে জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে ৮০ থেকে ৮২টি মামলা করা হয়েছিল। ৫টি মামলায় তার দণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে খালাস পেয়েছেন। বাকি চারটি আদালতে বিচারাধীন আছে, এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি। তিনি জানান, গত ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত তারেক রহমানের মোট ৩৯টি মামলা বাতিল বা খারিজ কিংবা খালাস পেয়েছেন। এর মধ্যে একটি মামলায় তিনি খালাস পেয়েছেন। আর বাকি ৩৮টির মধ্যে কোনো কোনো মামলা বাতিল হয়েছে, আবার কোনোটি খারিজ হয়েছে।
কায়সার কামাল আরও জানান, হাইকোর্টে ৯টি মামলা আইনগতভাবে বাতিল হয়েছে এবং একটি মামলায় (একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা) তারেক রহমান বেকসুর খালাস পান। বাকিগুলো সংশ্লিষ্ট আদালত (জজ এবং ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট) কর্তৃক বাতিল বা খারিজ হয়েছে। এখন পর্যন্ত তারেক রহমানের কোনো মামলা প্রত্যাহার হয়নি বলে জানান তার এই আইনজীবী। কায়সার কামাল বলেন, তারেক রহমান দেশের প্রচলিত আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সংবিধানের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল। তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত প্রত্যেকটি মামলা ভিত্তিহীন। তারপরও তিনি আদালতের মাধ্যমে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি চান।
সেনা সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। পরের বছর ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য সপরিবারে যুক্তরাজ্য যান। তখন থেকেই তিনি লন্ডনে রয়েছেন। লন্ডনে থাকাকালে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিতে তার মা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন ‘সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান’ তারেক রহমান। সেখানে থেকেই তিনি দল পরিচালনা করছেন। বিএনপি নেতারা বলছেন, তারেক রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনেই ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার দেশে ফেরা খুবই কাক্সিক্ষত এবং নেতাকর্মীরা সে দিকেই চেয়ে আছে।
জানা গেছে, তারেক রহমানের মামলাগুলো বর্তমানে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তিনি খালাস পাচ্ছেন। বাকি মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সে ব্যাপারে আইনজীবীরা তৎপর রয়েছেন। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, তারেক রহমান দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরে আছেন। এ ক্ষেত্রে তার দেশে ফেরার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান কী, দলের পক্ষ থেকে সেটা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে যুক্ত প্রভাবশালী দেশগুলোর মনোভাবও জানার চেষ্টা করবে বিএনপি।
দলটি আশা করছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের ক্ষেত্রে তার নেতৃত্ব ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনিই আগামীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক।
আলাপকালে বিএনপির নেতারা বলেছেন, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদী সরকার যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করেছিল, সেটি এখন বিশ্বজুড়ে স্পষ্ট হয়ে গেছে। ফলে তার দেশে ফেরার ক্ষেত্রে আইনি বা রাজনৈতিক বিষয় কোনো ইস্যু হবে না।
সাজা হওয়া মামলাগুলোর হালহকিকত
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সমাবেশ চলার সময় গ্রেনেড হামলা হয়। সেই হামলায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন ৪০০-এর বেশি নেতাকর্মী। জজ আদালত এ মামলায় ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিল। বহুল আলোচিত এ মামলায় গতকাল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আসামিদের সবাইকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা : ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। একই সাথে তারেক রহমানসহ অন্য পাঁচ আসামিকে দশ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। হাইকোর্ট পরে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড বাড়িয়ে ১০ বছর করে। এই মামলায় খালেদা জিয়া দুই বছর কারাভোগ করেন। ২০২০ সালে শর্তসাপেক্ষে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর রাষ্ট্রপতির আদেশে খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করে দেয়া হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে।
জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদের মামলায় কারাদণ্ড : ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেক রহমান, তার স্ত্রী ডা: জুবাইদা রহমান ও জুবাইদা রহমানের মা সৈয়দা ইকবাল বানুর বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিল দুদক। অভিযোগ ছিল, তারেক রহমান ও তার স্ত্রীর ঘোষিত আয়ের বাইরেও ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থের অবৈধ সম্পদ রয়েছে। গত বছরের (২০২৩ সাল) আগস্টে এ মামলায় তারেক রহমানকে ৯ বছরের এবং তার স্ত্রী জুবাইদা রহমানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয় ঢাকার একটি আদালত।
অর্থপাচার মামলা : ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের একটি মামলায় ঢাকার একটি আদালত তারেক রহমানকে খালাস দেয়। ওই মামলায় তারেকের বন্ধু ও ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। বিচারিক আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে দুদক। ২০১৬ সালে বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয় হাইকোর্ট। পাশাপাশি ২০ কোটি টাকা জরিমানা করেন।
মানহানির মামলায় দণ্ড : ২০১৪ সালে লন্ডনে এক সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজাকার ও পাক বন্ধু উল্লেখ করে তারেক রহমান নানা অবমাননাকর কটূক্তি করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগ এনে সে সময় নড়াইলে তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান বিশ্বাস। ওই মামলায় ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয় নড়াইলের আদালত।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, ‘তারেক রহমান আমাদের মধ্যে সহি-সালামতে ফিরে আসবেন খুব তাড়াতাড়ি। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা তাকে সুস্থ করেছেন, সুস্থ রেখেছেন ও মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন।’