স্বদেশ ডেস্ক: শরতের রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। প্রকৃতির শুভ্রতাকে উপভোগ করাছিলেন সার্জেন্ট মো. শহিদুল ইসলাম, যিনি র্যাব ৬-এর বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের অন্যতম সদস্য। এর মধ্যেই ফোন আসে। ছুটে যান যশোরের অভয়নগর থানায়। স্যুট, আয়রন ব্লকসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পরে প্রস্তুত হন বোমার সঙ্গে ‘যুদ্ধে’ নামতে। কিন্তু ব্যতিক্রমী ও শক্তিশালী বোমা ইম্প্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) নিষ্ক্রিয় করার আগেই অনাকাক্সিক্ষতভাবে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। বোমার স্পিøন্টারের আঘাতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য জ্ঞান হারান শহিদুল ইসলাম। জ্ঞান ফিরলে দেখেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তার হাতের কব্জি। গামছা দিয়ে সেই হাত বেঁধে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় যশোর সিএমএইচে।
২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের ওইদিনে ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলা। অপারেশন থিয়েটার থেকে কেবিনে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসকের কাছে শহিদুল ইসলাম জানতে চানÑ বাংলাদেশ জিতেছে কিনা। কিছুটা
আশ্চর্য হয়েই চিকিৎসক তখন বললেন, ‘মনিটর স্ক্রলে দেখেন, আপনার অবস্থা গুরুতর দেখাচ্ছে। শারীরিক এই অবস্থা নিয়েও আপনি ক্রিকেট খেলার আপডেট জানতে চাচ্ছেন?’ বোম্ব স্যুট ও আয়রন ব্লকের জন্য এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান বলে মনে করেন সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা।
দুঃসহ সেই স্মৃতির বর্ণনা দিয়ে সার্জেন্ট শহিদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘অনেক মানুষ তো দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অঙ্গহানির শিকার হন। আমি তো দেশের হয়ে কাজে গিয়ে পঙ্গু হয়েছি। দেশের কাজ করতে পেরেছি, তাতেই আমি গর্বিত। কারণ আমাদের প্রশিক্ষণের সময় দেশের প্রয়োজনে জীবন বিসর্জনের শপথ নিতে হয়। বাংলাদেশ দলের খেলার খবর জানতে চাওয়ার পেছনে হয়তো আমার দেশপ্রেমটাই কাজ করেছিল। বিষয়টি তখন না বুঝলেও এখন অনুভব করি।’
বাংলাদেশ সেনাবাহনীতে ১৯৯৯ সালে সৈনিক পদে যোগ দেন মৌলভীবাজারের ছেলে শহিদুল ইসলাম। বাবা-মা, স্ত্রী আর সাত বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে মীমকে নিয়েই তার পরিবার। সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে ২০০৬ সালে প্রথমবার র্যাবে যোগ দেন শহিদুল। পরে মিশন শেষ করে ২০১০ সালে আবারও র্যাবে ফেরেন। ২০১৮ সালে তৃতীয়বারের মতো পুলিশের এই বিশেষ বাহিনীটিতে যোগ দেন। সর্বশেষ কাজ করতেন র্যাব ৬-এর বোম্ব ডিসপোজাল টিমে। তার এই টিম দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলায় বোমা নিষ্ক্রিয়ের কাজ করে।
নিজের সাহসী কাজের জন্য প্রসংশায় ভেসেছেন শহিদুল ইসলাম। পেয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বিপিএম (সাহসিকতা)। র্যাব ও সেনা সদর থেকেও পেয়েছেন আর্থিক সম্মাননা। দীর্ঘ চিকিৎসার পর এখন কিছুটা সুস্থ শহিদুল। র্যাবের তত্ত্বাবধানে বিচ্ছিন্ন কব্জিতে সংযোজন করা হয়েছে দুটি কৃত্রিম হাত। এর মধ্যে একটি মায়োফিসিল সেন্সর হ্যান্ড। এটি হাতের ওপরের দিকের রগের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে অগ্রভাবে দিকনির্দেশনা পৌঁছায়। শারীরিকভাবে কিছুটা অক্ষম হয়ে পড়ায় সেনাবাহিনীর মিলিটারি মেডিক্যাল বোর্ড অবশ্য শহিদুল ইসলামকে ইউনিফর্ম চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের সুপারিশ করেন। বিধি অনুযায়ী তাকে বাহিনীর সিভিল স্টাফ হিসেবে নিয়োগের জন্য বলা হয়; কিন্তু শহিদুল তাতে রাজি না হয়ে সিদ্ধান্ত নেন ২২ বছরের চাকরি জীবনের ইতি টেনে অবসরে যাওয়ার। গতকাল বুধবার ছিল র্যাবে শহিদুল ইসলামের শেষ কর্মদিবস।
এ প্রসঙ্গে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শারীরিকভাবে ফিট থাকলে হয়তো আরেকটা র্যাংক পেতাম। আরও কয়েক বছর সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে পারতাম। তবে দেশ-মাতৃকার টানে এমন একটি কাজ করতে পেরে আমি গর্বিত। আহত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাব আমাকে যে সম্মান দেখিয়েছে, তার জন্য আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।’ নিজের কৃত্রিম হাত খুলে দেখানোর সময় অবশ্য শহিদুল ইসলামের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন আমাদের সময়কে বলেন, ‘দায়িত্বরত অবস্থায় নিহত বা আহত সব র্যাব সদস্যের প্রতি আমরা সর্বোচ্চ সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেই। সর্বোচ্চ সামর্থ্য নিয়ে পাশে দাঁড়াই। কারণ আমরা মনে করি এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।’
উল্লেখ্য, পেশাগত দায়িত্ব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত র্যাবের তিন শতাধিক সদস্য আহত হয়েছেন। এছাড়া নিহত হয়েছেন ২৭ জন র্যাব সদস্য।