শনিবার, ২৫ মে ২০২৪, ১২:৩৬ পূর্বাহ্ন

বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস: ২০২১ সালে মহামারি কোন দিকে যাবে?

বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস: ২০২১ সালে মহামারি কোন দিকে যাবে?

স্বদেশ ডেস্ক: ২০২০ সাল ছিল মানবসভ্যতার জন্য কল্পনাতীত এক বছর। তবে বিদায় ঘটেছে ২০২০ সালের। নতুন আশা নিয়ে এসেছে ২০২১ সাল। নতুন এই বছরে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির পরিস্থিতি কেমন হতে পারে ও বিদায়ী বছর থেকে আমরা কী শিখেছি সে বিষয়ে স্কাই নিউজকে নিজেদের মতামত জানিয়েছেনচারটি ভিন্ন খাতের চার বিশেষজ্ঞ।

ভাইরোলজিস্ট ডা. স্টিফেন গ্রিফিন, সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব মেডিসিন, ইউনিভার্সিটি অব লিডস
আগামী বছর মহামারি পরিস্থিতি কেমন হবে তা নির্ভর করে টিকার সরবরাহ, বণ্টন ও কোন টিকা অনুমোদন পায় তার উপর।

এর মধ্যে কিছুটা ব্রেক্সিটের উপর নির্ভরশীল- সবকিছু ডোভারের বাইরে এম২০ মোটরওয়েতে আটকে থাকে তাহলে সেটা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বেশকয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন টিকা অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। অনেকগুলো বিকল্প থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেগুলোর কার্যকারিতার ধরণের উপর ভিত্তি করে সেগুলো ব্যবহার করতে হবে। আমরা যদি আমাদেরঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যাকে রক্ষা করতে পারি তাহলে মৃতের সংখ্যা কমে আসবে।

কিন্তু বাকিদেরও টিকা দিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী করোনার ব্যাপারেও ভাবতে হবে আমাদের।

আমি বলবো যে, ৬৫ বছরের কম বয়সীদের টিকা দেওয়ায় আরো অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ। ব্যাপারটা এমন না যে, কেবল বয়স্কদের টিকা দিলেই ভাইরাসটি চলে যাবে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলোতো আছেই- টিকার প্রতিরোধ ক্ষমতা কতদিন টিকবে? টিকাগুলো সংক্রমণ বন্ধে সক্ষম কিনা?

টিকা দেওয়ার পরও যদি আমাদের অজান্তে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে তাহলে সেটাও একটা সমস্যা। আমরা এখনো উপসর্গহীন সংক্রমণ পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। এ সংক্রমণ বুঝে উঠা সকল টিকার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এর উপর নির্ভর করে টিকার ব্যবহার নির্ধারণ করা হবে।

জনসংখ্যার মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে সংক্রমণ অব্যাহত থাকার আশঙ্কা আছে। আমি আশা করছি যে, ফাইজার আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত টিকা উৎপাদন করতে পারবে, মডার্নার টিকা অনুমোদন পাবে ও এস্ট্রাজেনেকার টিকা পর্যাপ্ত কার্যকারিতা অর্জন করতে পারবে।

আমাদের মোট জনসংখ্যার অন্তত দুই-তৃতীয়াংশকে টিকা দিতে হবে। কোনো আদর্শ বিশ্বে- হয়তো এরপর প্রতি বছর আমরা সবাই টিকাটি গ্রহণ করতে পারবো, আর কেউ ভাইরাসটিতে মারাও যাবে না।

কিন্তু তেমনটা নাও হতে পারে। অন্যান্য দেশগুলো সুরক্ষিত না থাকলে অবকাশ যাপনে ভ্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। সেখান থেকে নিজের অজান্তেই আমরা ভাইরাসটি ছড়াতে পারি।

যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে আমার প্রত্যাশা হচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যাকে আগামী শীতের আগেই সুরক্ষিত করে তোলা। তাহলে বসন্তের আগ দিয়ে কমিউনিটি সংক্রমণ নাটকীয়ভাবে কমে আসবে। আমি বলছি না গ্রীষ্মের আগেই মহামারি চলে যাবে তবে, হয়তো তখন আমাদের এত কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে না।

শেফ (রাধক/পাচক)
টম আইকেন্স,লন্ডনের মিউজ রেস্তোরার মালিক ও প্রধান শেফ, আবু ধাবির বিভিন্ন রেস্তোরার প্রধান শেফ, গ্রেট বৃটিশ মেনু-র বিচারক, মিশেলিন তারকাপ্রাপ্ত কনিষ্ঠতম শেফ করোনা মহামারি ও ব্রেক্সিটের কারণে ২০২০ এর তুলনায় আতিথেয়তা শিল্পের পরিস্থিতি ২০২১ সালে আরো অনেক বেশি খারাপ হতে পারে।

আমরা একজন আতিথেয়তা বিষয়ক মন্ত্রী নির্বাচনের আহ্বান জানাচ্ছি। এই বছর আমাদের দেখিয়েছে যে, পার্লামান্টে আমাদের এমন একজনকে দরকার যিনি আমাদের শিল্পের প্রয়োজনগুলো প্রকৃত অর্থে বোঝেন।

মহামারি শেষ হতে অনেক দেরি আছে। বিধিনিষেধ শিথিলের আগে ২ কোটি মানুষকে টিকা দিতে চায় সরকার। তাতে ইস্টার (৪ঠা এপ্রিল) পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। আমি আমার টিমকে বলেছিলাম যে, জানুয়ারিতে আমাদের ব্যবসা খোলার সুযোগ নেই, হয়তো ফেব্রুয়ারিতে খোলা যেতে পারে। কিন্তু এরপরই লন্ডনে চতুর্থ মাত্রার নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। তাই মার্চ বা এপ্রিলের আগে ব্যবসা চালুর সুযোগ নেই।

ক্রিসমাসের আগের দিনগুলোতেই আতিথেয়তা বিষয়ক ব্যবসাগুলো অতিরিক্ত কিছু অর্থ আয় করে থাকে। কিন্তু এ বছর তা সম্ভব হয়নি। ধীরে ধীরে অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এই ব্যবসাগুলোর জন্য তৃতীয় বা চতুর্থ মাত্রার বিধিনিষেধেরচেয়ে পুরোপুরি লকডাউনই ভালো অপশন। সেক্ষেত্রে আমরা সরকার হতে সহায়তা পাই।

জানুয়ারিকে দেখা হচ্ছে মহামারির সবচেয়ে কঠিন মাস হিসেবে। এই অবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন বাড়ির মালিকরা। সাধারণত তারাই বাড়ির বিল পরিশোধ করে থাকেন। কিন্তু আগামী মাসগুলোয় তাদের সত্যিকার অর্থে ক্ষমাশীল হতে হবে।

আমার বাড়িওয়ালা অবশ্য আমার সঙ্গে বেশ ভালো আচরণ করছেন। লন্ডনের বেশিরভাগ বাড়ির মালিকেরাই পরিস্থিতিতে সহায়ক আচরণ করছেন। তবে দুখের খবর হচ্ছে, অনেকগুলো রেস্তোরাঁই বন্ধ হয়ে যাবে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি।

সাইকোলজিস্ট
স্টিফেন রেইচার, সাইকোলজি বিষয়ক অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব সেইন্ট অ্যান্ড্রিওস, বৃটিশ ও স্কটিশ সরকারের করোনা বিষয়ক উপদেষ্টা
এই মহামারি আমাদের সমাজের তিনটি বড় দিক তুলে ধরেছে যেগুলো পরিবর্তন করা উচিৎ:
১। প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক
৮০ বছর আগেই গবেষণায় বলা হয়েছে যে, প্রকৃতির সঙ্গে মিলে বাস করার বদলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আমরা শেষ। এ বছর তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ছোটবেলায় আমি গ্রীষ্মের প্রথম স্ট্রবেরির জন্য অপেক্ষা করতাম। খাবার তখন মৌসুমি ছিল। কিন্তু এখন আমরা ভাবি যে, মৌসুমগুলোকে অগ্রাহ্য করতে পারবো। আর এটা একধরণের ইঙ্গিত যে, আমরা এখন মৌসুমকে অস্বস্তিদায়ক ভেবে অগ্রাহ্য করি। প্রভাব খাটাই। এর জন্য মূল্য দিতে হয়।
আমরা এখন আবিষ্কার করছি যে, প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করার পরিণাম হচ্ছে করোনার মতো বিশাল মূল্য পরিশোধ করা। চীনের ওই প্রাণী বেচা-কেনার বাজারগুলোয় -যেখান থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়- মানুষের পাশাপাশিই বাস করে বিভিন্ন প্রজাতীর প্রাণী। ভাইরাসগুলোর জন্য এক প্রজাতী থেকে অন্য প্রজাতীতে স্থানান্তরের আদর্শ পরিবেশ এটি।
ভাইরাসের বিপদ ভাইরাসের ভেতরে নয়, আমাদের প্রস্তুতিতে। উত্তর আমেরিকায় কলোনি স্থাপনের পর বহু রোগ ছড়িয়েছে যেগুলোয় বহু আদিবাসী মানুষ মারা গেছেন।
২। পরস্পরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক
এই মহামারি মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের গুরুত্ব দেখিয়েছে। এই মহামারির অন্যতম ট্র্যাজেডি হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব। এ দিয়ে আমরা শারীরিক দূরত্বকেই বোঝাই। সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কোনো দলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আমাদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। কোনো দলের সদস্য হলে আপনি অনুভব করবেন যে, আপনাকে সহায়তা করার লোক আছে। এটা মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
সামাজিক আইসোলেশন দিনে ২০টি সিগারেট খাওয়ার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। একটা ভালো সমাজের জন্য আমাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে আরো সংযুক্ত থাকতে হবে, বিভিন্ন দলের সদস্য হতে হবে।

৩। অসমতা
এই মহামারি অসমতায় ভরা ছিল। হাসপাতাল বেড, পিপিই ও পরীক্ষা সবকিছুতেই আমারা অপ্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হচ্ছে স্কুলে সংক্রমণ। সাধারণত শ্রেণিকক্ষগুলো জনবহুল হয়। তাছাড়া, ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বড় শ্রেণিকক্ষগুলো আছে বৃটেনে, তাই এটা নিয়ে উদ্বেগও বেশি।

এছাড়া, মানুষজন আক্রান্ত হওয়া নিয়েও অনেক ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছে। সুবিধাবঞ্চিতদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। তারা গণপরিবহনে বেশি চড়ে, জনাকীর্ণ বাড়িতে বাস করে ও তাদের কাজে যেতে হত। সমাজের এ দিকটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।

কেয়ার হোমসের কর্মীদের অনেক ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কাজ করতে হয়েছে। তাদের অনেক অসুস্থ মানুষের দেখাশোনা করতে হয়। ঘরের ভেতরে যাওয়া ছাড়া তাদের কাছে উপায় নেই। কম মজুরির সমস্যাগুলো নিয়েও আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।

আবাসন হওয়া উচিৎ নিরাপদ, প্রশস্ত, আলো-বাতাসযুক্ত। এছাড়া ডিজিটাল অসমতাতো আছেই। দরিদ্র শিক্ষার্থীরা ল্যাপটপের অভাবে বাড়ি থেকে পড়াশোনা করতে পারেনি।

এই মহামারির মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার উক্তিগুলোর একটি ছিল কানাডার বৃটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের স্বাস্থ্যকর্মী বনি হেনরির। তিনি বলেন, আমরা সবাই একই ঝড় পার করছি, কিন্তু সবাই একই জাহাজে নই।

করোনার মধ্যে আমরা অনেককিছুই করেছি, কিন্তু সেগুলো পর্যাপ্ত নয়। দরিদ্র এলাকার মানুষজন চার গুণ বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। আমাদের আরও অনেক করতে হবে। আমাদের এমন একটা উপায় বের করতে হবে যাতে আরেকটি স্বাস্থ্য সংকট তৈরি না হয়।

অর্থনীতিবিদ
মার্টিন বেক, লন্ডন ইকোনমিকসের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও যুক্তরাজ্যের সাবেক কোষাধ্যক্ষ বিষয়ক অর্থনীতিবিদ
আমি মনে করি, সফলভাবে টিকা দেওয়া হলে এ বছর অনেকটা ইতিবাচক হবে। ২০০৮, আশির দশক ও নব্বইয়ের দশকের আর্থিক মন্দার সময়ে সৃষ্ট সমস্যাগুলো দূর হতে অনেক সময় লেগেছিল। কিন্তু এবার অর্থনীতির মৌলিক কোনো বিষয়ে সমস্যা নেই, এমন কোনো ভারসাম্যহীনতা নেই যেটি সামলাতে হবে। অর্থ ব্যয় কমায় ও কাজ থেকে দীর্ঘ ছুটি পাওয়ায় মানুষের গৃহস্থালী সঞ্চয় বেড়েছে।

ব্যাংকে অঢেল অর্থ পড়ে আছে। এ অর্থ ভোক্তা খাতের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পূর্বের অর্থনৈতিক মন্দাগুলোর সময় ব্যাপক পরিমাণের ঋণ ছিল। কিন্তু এবার সুদের পরিমাণ কমই থেকেছে, ভোক্তা ক্রেডিট ঋণাত্মক রয়েছে, মানুষজন ক্রেডিট কার্ডের ঋণ শোধ করছে-  অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা রয়েছে।

প্রত্যাশা করা হচ্ছে যে, কর্মীদের দীর্ঘসময় ছুটি দিয়ে কর্মসংস্থান কোনোরকমে বাঁচিয়ে রাখা যাবে ও পরবর্তীতে তা পুরোদমে চালু করা যাবে। কিন্তু কিছু খাতে এমনটা ঘটবে না।ইতিহাস এমনটাই বলে। কিন্তু মানুষ কাজে ফিরবেই। অর্থনীতির জোরালো পুনরুত্থানের জন্য পর্যাপ্ত উপাদান বিদ্যমান আছে বর্তমানে।

আতিথেয়তা খাত এ মহামারিতে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। কিন্তু যারা মহামারিতে রেস্তোরা হারিয়েছেন তারা ফের আরো সহজ কিছু – যেমন ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনো কারখানা- নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।

বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে, মানুষের কাছে অর্থ থাকলে ও বিমান উড়লে খুব দ্রুতই এ ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে। মহামারিতে বহুদিন ধরে ছুটি আটকে রাখা হয়েছে। মানুষজন এখনো অবকাশ যাপন করতে চায়।

সরকার বিশাল অঙ্কের অর্থ ঋণ নিচ্ছে, কিন্তু ভার্চুয়ালি তা কিছুই না। এ ঋণ বহুদিন পর্যন্ত শোধ করতে হবে না। কনজারভেটিভ পার্টির উচিৎ আরো ঋণ নেওয়া।
(স্কাই নিউজ থেকে অনূদিত)

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877