বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ১০:১৯ অপরাহ্ন

দামের আগুনে পোড়া আলু

দামের আগুনে পোড়া আলু

স্বদেশ ডেস্ক:

করোনা মহামারীর এই ক্রান্তিকালেও বেড়েই চলেছে খাদ্যপণ্যের দাম। পেঁয়াজ, চাল, তেল, ডিম, সবজি, কাঁচামরিচসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দামই বেড়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের খাদ্যতালিকায় আলু এমনিতেই অপরিহার্য। তদুপরি অন্য সব সবজির চড়া দামের কারণে এ পণ্যটির প্রতি নির্ভরতা আরও বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু দামের আগুনে পুড়ে গেছে আলুও। ভোক্তাপর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রির বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে বেধে দেওয়া হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ দামে। পণ্যটির ঊর্ধ্বমূল্য রোধে দেশের ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে। কিন্তু দামের ঊর্ধ্বগতি থামানো যায়নি।

রাজধানীর খুচরা বাজারে দুই-তিন সপ্তাহ আগেও প্রতিকেজি আলুর দাম ছিল ৩০-৩৫ টাকা। অল্প সময়ের ব্যবধানে এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে এ দেশের সব মানুষের কাছেই অবশ্য প্রয়োজনীয় এ খাদ্যপণ্যটির এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ ভোক্তারা। বিশেষ করে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের জীবনধারণই কঠিন হয়ে পড়েছে। আলুর রেকর্ড দামে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বাজার বিশ্লেষকরাও।

কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, করোনায় এমনিতেই মানুষের আয় কমে গেছে। চড়া দামের মাছ-মাংস কিনে খাওয়ার সামর্থ্য সবার নেই। দীর্ঘসময় ধরে একে একে নাগালের বাইরে চলে গেছে তরিতরকারির দামও। এখন আলুও দরিদ্রদের নাগালের বাইরে চলে গেল! বাজারে কোনো কিছুর দামই সহনীয় পর্যায়ে নেই। এটা উদ্বেগজনক।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কাঁচাবাজার ও খুচরা দোকান ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা কেজি দরে। গত বৃহস্পতিবার যা বিক্রি হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি। আগের সপ্তাহে ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি।

এরও আগে বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। অর্থাৎ আড়াই সপ্তাহে দাম বেড়েছে ২০ টাকা। ব্যবসায়ীরাও বলছেন, আলুর দাম কখনই এতটা বাড়েনি আগে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশও (টিসিবি) বলছে, এক বছরের ব্যবধানে আলুর দাম দ্বিগুণ বেড়েছে।

আড়তদাররা জানান, উৎপাদন মৌসুমের শেষদিকে ব্যবসায়ীরা মুন্সীগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, কিশোরগঞ্জ, রংপুর ও রাজশাহীর বিভিন্ন আড়তে আলু মজুদ করেন। পরে শীত মৌসুম শেষ হয়ে গেলে কোল্ডস্টোরেজ থেকে সারাদেশের পাইকারি বাজারে আলু সরবরাহ করেন ব্যাপারীরা। আর ব্যাপারীরা বলছেন, এ বছর আলুর চাহিদা গত বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। অথচ গত মৌসুমে সে পরিমাণে আলু মজুদ করা হয়নি।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর করোনা বিপর্যয়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ আলু ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। এতে আলুর সাধারণ মজুদে টান পড়েছে। তা ছাড়া বন্যায় এবার জমিতে আলুর উৎপাদনও কম হয়েছে। তাই বছরের এ সময়ে সরবরাহ কমে গেছে। এর প্রভাব দামের ওপরেও পড়েছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আলুর চাহিদা প্রায় ৭৭ লাখ ৯ হাজার টন। গত মৌসুমে প্রায় ১ কোটি ৯ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। গত বছর উৎপাদিত আলু থেকে প্রায় ৩১ লাখ ৯১ হাজার টন আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিছু পরিমাণ আলু রপ্তানি হলেও ঘাটতির সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।

অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, গত মৌসুমে প্রতিকেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ৮ টাকা ৩২ পয়সা। মৌসুমে যখন হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে তখন প্রতিকেজি আলুর দাম ছিল সর্বোচ্চ ১৪ টাকা। প্রতিকেজি আলুতে হিমাগার ভাড়া বাবদ ৩ টাকা ৬৬ পয়সা, বাছাই খরচ ৪৬ পয়সা, ওয়েট লস ৮৮ পয়সা, মূলধনের সুদ ও অন্যান্য খরচ বাবদ ২ টাকা ব্যয় হয়। অর্থাৎ এক কেজি আলুর কোল্ডস্টোরেজ পর্যায়ের সর্বোচ্চ ২১ টাকা খরচ পড়ে। হিমাগারে আলু সংরক্ষণ ও বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীদের মুনাফার পর পণ্যটির দাম পাইকারি পর্যায়ে ২৫ এবং ভোক্তাপর্যায়ে ৩০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।

অথচ খুচরায় এখন ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে আলু। শুধু খুচরাতে নয়, পাইকাররাও বলছেন অতিরিক্ত দামে আলু সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের। কারওয়ানবাজারের আলুর পাইকার মুজিবর হোসেন বলেন, গত বুধবার (৭ অক্টোবর) ৩৫ টাকা কেজিতে আলু কিনে পাইকারিতে বিক্রি করেছি ৩৮ টাকায়। সেখানে গত বৃহস্পতিবার আমাদেরই আলু কিনতে হয়েছে ৪০ টাকা কেজি দরে। পরদিন পাইকারি বাজারে আলুর দাম বেড়ে হয় ৪৪ থেকে ৪৭ টাকা। তবে গতকাল কারওয়ানবাজারের আড়তগুলোতে দাম কিছুটা কমেছে। এদিন পাইকারিতে আলু বিক্রি হয়েছে ৪২ থেকে ৪৪ টাকা কেজি দরে।

গতকাল কারওয়ানবাজারে পাইকারিতে বিক্রমপুরের আলু ৪২ টাকা, রাজশাহীর আলু ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। খুচরায় বিক্রি হয়েছে ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা কেজি।

কারওয়ানবাজারে কমলেও রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় খুচরাতে দাম কমেনি। মালিবাগ বাজারের ব্যবসায়ী মীর সোহেল জানান, খুচরায় বিক্রমপুরের আলুর দাম এখন চাওয়া হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি। অন্যদিকে রংপুর ও রাজশাহীর আলুর দাম চাওয়া হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৪ টাকা কেজি। এলাকার খুচরা দোকানগুলোয় আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ সবজির ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন তরিতরকারির দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় আলুর ওপর চাপ বেড়েছে। চাহিদার সুযোগ নিয়ে মজুদদাররা বেশি দামে আলু বিক্রি করছেন।

এদিকে ভোক্তাপর্যায়ে প্রতিকেজি আলুর দাম সর্বোচ্চ ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এ দরে আলু বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করতে সম্প্রতি ৬৪ জেলার প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। হিমাগার পর্যায় থেকে প্রতিকেজি আলুর দাম ২৩ টাকা, পাইকারি/আড়তে এর মূল্য ২৫ টাকা এবং ভোক্তাপর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩০ টাকা হওয়া? উচিত বলে জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হবে না। সবার আগে বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক করতে হবে। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তা হলো দেশে আলুর পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।

অতিরিক্ত মুনাফার লোভে অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুদ করছেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বাজার তদারকি ও কোল্ডস্টোরেজগুলোয় নজরদারি বাড়াতে হবে। কোনো ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মজুদ করছেন কিনা, পণ্য আটকে রাখছেন কিনাÑ সেদিকে নজর রাখতে হবে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখা গেলে দাম এমনিতেই কমে আসবে।

ভোক্তা অধিকারের অভিযান

বাজারে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গতকাল রাজধানীর কারওয়ানবাজারে বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হয়।

অভিযান পরিচালনা করেন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মাসুম আরেফিন। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, অভিযানে বেশি দামে আলু-পেঁয়াজ বিক্রি করায় ৩ ব্যবসায়ীকে ১২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানকালে অনেক পাইকারি আলু বিক্রেতাকে দোকানে পাওয়া যায়নি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877