বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৫:৫৭ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
নারী পাচার করে ছিঁচকে চোর আজম এখন কোটিপতি

নারী পাচার করে ছিঁচকে চোর আজম এখন কোটিপতি

স্বদেশ ডেস্ক:

মো. আজম ওরফে আজম খান। বাবার নাম মাহবুবুল আলম। গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি পৌরসভায়। এক সময় এলাকায় ছিঁচকে চোর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দলে ভিড়ে নিজেও হয়ে ওঠেন দুর্ধর্ষ। ফটিকছড়িসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছয়টি হত্যা মামলাসহ ১৫টি মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় একপর্যায়ে তিনি পাড়ি জমান দুবাই। এর পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি আজমকে। সেখানে নারী ঘটিত অনৈতিক ব্যবসার জাল বিছিয়ে পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ। বাংলাদেশ থেকে নারী পাচার করে রাতারাতি হয়ে ওঠেন কোটিপতি। এখন দুবাইয়ের চারটি হোটেলের মালিক আজম খান। সেগুলোতে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে আট বছরে পাচার করেছেন দেশের ৭০ তরুণী। তাদের প্রত্যেককেই বাধ্য করেছেন যৌন ব্যবসায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।

দুবাই পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, দুবাইয়ে নারী পাচারকারী চক্রের মূল হোতা আজম খানসহ পাঁচজনকে গত জুলাইয়ে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। জিজ্ঞাসাবাদে আজম জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন নাচের ক্লাব বা সংগঠন থেকে মেয়েদের সংগ্রহ করে কাজ দেওয়ার প্রলোভনে পাঠাতেন দুবাই। সেখানকার হোটেল ও ড্যান্সবারে এসব মেয়েদের যৌনকর্মে বাধ্য করতেন তারা। গত ১৩ জুলাই ঢাকা মেট্রোপলিটান মেজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলামের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক
জবানবন্দিতেও চাঞ্চল্যকর বয়ান দিয়েছেন আজম। বলেছেন- দেশের কয়েকজন নৃত্য সংগঠক নারী পাচারের এ চক্রে জড়িত। তার দেওয়া তথ্যে উঠে আসে চক্রের অন্যতম দুই সদস্যের নাম- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী নৃত্যশিল্পী-শিক্ষক ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগ এবং চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের ম্যানেজার গৌতম সাহা।

রাজধানীর নিকেতনের একটি বাসা থেকে গত বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেপ্তারের পর ইভান শাহরিয়ারও নারী পাচারের এ র‌্যাকেটের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে। গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে ইতোমধ্যে তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের দেওয়া তথ্যে নারী পাচারের দায়ে শুধু নৃত্যশিল্পী ইভান শাহরিয়ারই নন, ফেঁসে যাচ্ছেন শোবিজ জগতের আরও অনেকেই। আদালতের নির্দেশে মো. আজম ও ইভান শাহরিয়ার এখন কারাগারে।

আজম আদলতকে জানান, দুবাই শহরে তার রেস্টুরেন্ট ও হোটেল ব্যবসা রয়েছে। গত বছর রমজানে ময়না, আলেয়া ও মনি আক্তারকে দুবাইয়ে অমির হোটেলে কাজ দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যান তিনি। এর পর তাদের নিজের গুলশান লাইফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট রেস্টুরেন্টে চাকরি দেন। গত সাত থেকে আট বছরে দেশ থেকে এভাবে ৬০ থেকে ৭০ কিশোরী-তরুণী নিয়েছেন আজম। ছয় মাস আগে বাংলাদেশে এসে করোনার কারণে আর দুবাই যেতে পারেননি। নৃত্যশিল্পী ইভান শাহরিয়ার এ কাজে আজমের সহযোগী ছিলেন। পাচারের উদ্দেশ্যে নারীদের সংগ্রহ করাই ছিল তার কাজ। মূলত তার একটি নাচের ক্লাব রয়েছে। সেই সূত্রে বিভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে তার সখ্যতা।

চক্রের আরেক সদস্য গ্রেপ্তার ইয়াসিন আদলতকে বলেন, আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেমন- গায়ে হলুদ, বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন প্রোগামে আর্টিস্ট (শিল্পী) নিয়ে যাই। কারও প্রোগ্রামের প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন দিলে আমি, অনিক ও রাসেলের ক্লাবের মাধ্যমে প্রোগ্রাম করতাম। প্রোগ্রামে অনেক আর্টিস্ট লাগত। এসব প্রোগ্রামে আমাদের অনেক মেয়ে আর্টিস্ট লাগত। সেই সুবাদে তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হতো এবং অনেক মেয়ে আর্টিস্ট আমাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য বলতো। আমি ২০১৫ সাল থেকে মেয়ে আর্টিস্টদের বিদেশে পাঠানোর কাজ করি। ২০১৬ সালে হৃদয়ের মাধ্যমে আজমের (মো. আজম) সঙ্গে পরিচয় হয়। হৃদয় ১০ হাজার টাকা কমিশনে দুবাইতে মেয়ে আর্টিস্ট পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। তার মাধ্যমে আমি নাহিদা, আফসানা ও মিম নামে তিনজন আর্টিস্টকে আজমের দুবাই ক্লাবে পাঠাই। আর আমি নিজে হালিমা, মৌসুমী ও তৌহিদাকে পাঠাই। আমি মূলত মেয়েদের বিদেশে পাঠানোর জন্য মিডিয়া হিসেবে কাজ করতাম। চট্টগ্রামের নাজিম আমার অনেক কাছের বন্ধু। জিম দুবাইতে ড্যান্স ক্লাব আছে সেখানে মেয়েদের ভালো বেতনে কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। তারা মেয়েদের থাকা খাওয়া নিশ্চিত করণসহ ক্লাবে নাচ, গান করার বিনিময়ে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন প্রদান করবে মর্মে মৌখিক চুক্তি হয়। ভালো বেতন দেবে বলে কথা থাকলেও প্রায় মেয়ে আর্টিস্ট ফোনে বা দেশে এসে কথামতো বেতন দেয় না বলে জানায়। দুবাইতে মেয়েদের নেওয়ার কাজে সহায়তা করে আজমের ভাই এরশাদ, আলমগীর, স্বপন, অনিক। দেশ থেকে এরশাদ আজমদের নারায়ণগঞ্জ থেকে আর্টিস্ট দেয় নায়িকা অপু বিশ্বাসের ম্যানেজার গৌতম, আক্তার, সোহাগ, রাসেল, অপূর্ব। নোয়াখালীর জিয়ার মাধ্যমে আমি ফাহিমা, হ্যাপি, জুঁই, রিতু নামের ৪ জন আর্টিস্টকে পাঠাই। প্রত্যেক আর্টিস্টের বিনিময়ে আমাকে ১০ হাজার করে টাকা দেয়। ২০১৮ সালের প্রথমদিকে ঢাকা থেকে মাইনউদ্দিন ওরফে মহিউদ্দিন নামে একজন মোবাইলে ফোন দিয়ে কম বয়সী দেখতে সুন্দরী আর্টিস্ট মেয়ে চাইলে আমি তার কাছে ২ জন আর্টিস্ট নিয়ে গেলে সে আমাকে ২ হাজার টাকা ভাড়া দেয়। এর পর সজিব নামে একজন ফোনে আমার কাছে আর্টিস্ট চাইলে আমি তাকে একজন আর্টিস্ট ঢাকা নিয়ে দেখালে সে আমাকে ১ হাজার টাকা ভাড়া দেয়। ২০১৮ সালের এপ্রিল, মে মাসের দিকে ইভান শাহরিয়ার সোহাগ নামে একজন ফোনে আমাকে ১ জন কম বয়সী আর্টিস্ট নিয়ে তার সঙ্গে ঢাকায় দেখা করতে বললে আমি ১ জন আর্টিস্ট নিয়ে ঢাকা বসুন্ধরা নিয়ে গেলে সে আমাকে আড়াই হাজার টাকা দেয়। কিছু দিন পর লোভনা মরিয়ম নামে এক ম্যাডাম আমাকে ফোনে বলে দেখতে সুন্দর ও কম বয়সী ভালো নাচতে পারে এমন ২ জন আর্টিস্ট নিয়ে কষ্ট করে গুলশানে নিয়ে গেলে তিনি আমাকে ও আর্টিস্টদের ভাড়া দিয়ে দেবে। কথা অনুযায়ী আমি ২ জন আর্টিস্টকে নিয়ে গেলে আমাকে ২ হাজার টাকা দেয়। বগুড়ার রকির মিজান একদিন আমাকে ফোন করে আর্টিস্ট চাইলে আমি তার কাছে আর্টিস্ট নিয়ে গেলে আমাকে ১ হাজার টাকা ভাড়া দেয়। পরে শুনি যে, মিজান মেয়েদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে বিদেশে পাঠায়। এভাবে ওয়াসিম, জসিম সোহেল রহমান, ওয়াছেক মোস্তাকিনুর রহমান, আনিছুর ইসলাম হিরু তারা বিভিন্ন সময় আমাকে গুলশান, বনানীসহ বিভিন্ন জায়গায় ফোনে ডেকে নিয়ে যেত। মেয়েরা বিদেশ থেকে ফোন করে কেউ ভালো আছে আবার কেউ কষ্টে আছে বলে জানাত। মেয়েদের গেস্টদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করতে বাধ্য করত। আমি অনুমান ৬ থেকে ৭ জন মেয়ে আর্টিস্টকে অনিক, হৃদয়ের মাধ্যমে দুবাইতে আজম ও এরশাদের কাছে পাঠাই। এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আমি অনুতপ্ত।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা জানান, মূলত নৃত্যশিল্পীদের টার্গেট করত চক্রটি। বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানে নৃত্যশিল্পিরাই ছিলেন এ পাচারকারী চক্রের প্রধান টার্গেট। কয়েকজন নৃত্যসংগঠক ও শিল্পী ছাড়াও পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন ক্লাব ও ড্যান্স গ্রুপের লোকজনও এ পাচার সিন্ডিকেটে জড়িত। বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে নারীদের সংগ্রহ করাই ছিল নৃত্যশিল্পী ইভান শাহরিয়ারের কাজ। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য রয়েছে। গত মাসে চক্রের মূল হোতা আজম খানসহ তার নারী পাচারকারী চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে তিনজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেই জবানবন্দির ভিত্তিতেই ইভানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চক্রের অন্য সদস্যদেরও আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877