বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ১০:৩৩ অপরাহ্ন

নির্দেশ মানেননি শওকত হাজির হননি আদালতে

নির্দেশ মানেননি শওকত হাজির হননি আদালতে

স্বদেশ ডেস্ক:

রাজধানীর ভাটারার ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেসের (ইউআইটিএস) উপাচার্যকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ৬০ কোটি ঢাকা চাঁদা দাবির মামলায় আদালতকে এক হাত দেখিয়েছেন ‘বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গলীগ’-এর প্রেসিডেন্ট শওকত হাসান মিয়া। চাঁদাবাজির ওই মামলায় ভুয়া ও জাল মেডিক্যাল সনদ দেখিয়ে ১২ আগস্ট জামিন পান শওকত। ঘটনা জানাজানি হলে ২৩ আগস্ট ঢাকার সিএমএম কোর্টের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিনুর রহমান আসামি ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ২৭ আগস্ট (গত বৃহস্পতিবার) সকাল ১০টায় আদালতে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের সেই নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হাজির হননি শওকত। উল্টো তার আইনজীবীরা আদালতের অভ্যন্তরে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

আদালত সূত্র জানায়, গতকাল এজলাসে হাকিমের উপস্থিতিতে শুনানি চলাকালে শওকতের আইনজীবীরা ঢুকে পড়েন বিচারকের খাসকামরায়। এতে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। খাসকামরায় আইনজীবীদের অবস্থান ও অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে শুনানির আদেশ দিতে বিব্রতবোধ করেন আদালত। বিষয়টি গড়িয়েছে ঢাকার সিএমএম জুলফিকার হায়াতের দপ্তর পর্যন্ত। বাদী পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শুনে খাসকামরায় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়াও আসামির জামিন বাতিলের আবেদনের অধিকতর শুনানির ব্যবস্থা গ্রহণেরও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

ইউআইটিএসের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান ভূঁইয়া আমাদের সময়কে বলেন, ইউআইটিএসের উপাচার্যকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ৬০ কোটি টাকা চাঁদাবাজির

অভিযোগে চলতি বছরের ২ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থানায় শওকত হাসান মিয়াসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয় (নম্বর-২ (১) ২০)। মামলাটি করেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী মো. মোস্তফা কামাল। ওই মামলায় ৮ জানুয়ারি উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান শওকত হাসান। আদালত তাকে ছয় সপ্তাহের জামিন দিয়েছিলেন। কিন্তু জামিনের মেয়াদ শেষ হলেও উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিম্নআদালতে আত্মসমর্পণ করেননি। পাঁচ মাস পর ২৭ জুলাই ঢাকার সিএমএম আদালতে শওকত হাসান মিয়া গুরুতর অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে আত্মসমর্পণপূর্বক জামিনের আবেদন করেন। অসুস্থতার সমর্থনে কোনো ডকুমেন্ট দেখাতে না পারায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বাকী বিল্লাহ জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। গত ১২ আগস্ট শওকত হাসানের আইনজীবীর মাধ্যমে ঢাকার পশ্চিম রামপুরার ডেলটা স্পেশালাইজড হসপিটালের প্যাডে দেওয়া একাধিক ‘চিকিৎসা সনদ’ ব্যবহার করে আদালতে জামিন আবেদন করেন। এ জামিন আবেদন করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাসুমুর রহমান মজুমদার ও এমএম গাফফার চোধুরী ইমন। প্রাপ্ত নথি পর্যালোচনা করে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শারাফুজ্জামান আনসারীর আদালত সে দিনই শওকত মিয়াকে জামিন দেন। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, আদালতকে যে চিকিৎসা সনদপত্র দেখিয়ে শওকত মিয়া জামিন নিয়েছেন তার পুরোটাই ছিল জাল ও ভুয়া।

বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকও (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) তদন্তসাপেক্ষে ১৮ আগস্ট লিখিতভাবে জানান, আসামি শওকত হাসান মিয়ার পক্ষে আদালতে দাখিল করা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট জাল। পরে ঢাকার সিএমএম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট শারাফুজ্জামান আনসারী আসামির অনুকূলে ১২ আগস্ট প্রদত্ত শওকত হাসান মিয়ার জামিন আদেশটি বাতিল ও জামিন সংশ্লিষ্ট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার জন্য ২০ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতের কাছে আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ আগস্ট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিনুর রহমান আসামির জামিন কেন বাতিল হবে না এবং আসামির উপস্থিতি নিশ্চিতকল্পে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেন। পাশাপাশি লিখিত বক্তব্যসহ আসামির উপস্থিতি সাপেক্ষে ২৭ আগস্ট (গতকাল) সকাল ১০টায় আদালতে উপস্থিত থাকার জন্য আইনজীবী অ্যাডভোকেট এমএ গাফফার চৌধুরীকে নির্দেশ দেন। একই দিন একই সময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকেও হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।

অ্যাডভোকেট আবদুুল মান্নান ভূঁইয়া আরও বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে সিএমএম কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিনুর রহমানের আদালতে বাদীপক্ষের আইনজীবী ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক নজিবুল্লাহ হিরু ও গাজী শাহ্ আলমের নেতৃত্বে দুই শতাধিক আইনজীবী আসামির জামিন বাতিলের আবেদনের ওপর শুনানি করেন। আদালত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার শুনানি গ্রহণ করেন। কিন্তু আসামি শওকত হাসান মিয়াকে ছাড়াই তার আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে পরে আদেশ দেবেন মর্মে উভয় পক্ষকে জানান। বিচারকের এজলাসে বাদীপক্ষের আইনজীবীরা আদেশের অপেক্ষায় ছিলেন। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাসুমুর রহমান মজুমদার ও এমএ গাফফার চৌধুরী বিচারকের খাসকামরায় অবস্থান করেছেন বলে আদালত জানতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে বাদীপক্ষের ঢাকা বারের সিনিয়র আইনজীবীসহ অন্য আইনজীবীর সামনেই খাসকামরা থেকে আদালতের সম্মুখে হাজির হওয়ার জন্য আসামির দুই আইনজীবীকে ডেকে পাঠান। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বিচারকের খাসকামরা থেকে আদালতের সামনে আসেন এবং বেরিয়ে যান।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হাকিম এই মামলার আদেশ দিতে বিব্রতবোধ করেন এবং বাদীপক্ষের আইনজীবীদের এ বিষয়ে প্রতিকারের জন্য সিএমএমের কাছে সাক্ষাৎ করার জন্য নির্দেশনা দেন। এই নির্দেশনা পেয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি গাজী মো. শাহ আলমসহ সিনিয়র আইনজীবীরা সিএমএম ঢাকা জুলফিকার হায়াতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাদীপক্ষের আইনজীবীরা বক্তব্য শুনে আদালত অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার বিষয়টি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আশ্বাস দেন এবং আসামির জামিন বাতিলের আবেদনের অধিকতর শুনানির জন্য শিগগিরই ব্যবস্থা নেবেন মর্মে আশ্বস্ত করেন।

অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে আসামি পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাসুমুর রহমান মজুমদার গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদককে বলেন, বৃহস্পতিবার আদালত চলাকালীন বিচারকের খাসকামরায় কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এটা স্রেফ অপপ্রচার; বরং গতকাল আদালতে তিনিই হেনস্তার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেন।

ইউআইটিএসের পক্ষে আইনজীবী মান্নান ভূঁইয়া জানান, সেনাবাহিনীর কোর্ট মার্শালের বিচারে চাকরিচ্যুত সিপাহি হয়েও অবসরপ্রাপ্ত মেজর পরিচয় দিয়ে দীর্ঘদিন প্রতারণা করে আসছেন বঙ্গলীগের প্রেসিডেন্ট শওকত হাসান মিয়া। যার তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। তিনি কেবল এ ৬০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি মামলারই আসামি নন। তার বিরুদ্ধে সমাজসেবায় একুশে পদকপ্রাপ্ত ও ইউআইটিএসের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এবং পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সূফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের স্বাক্ষর জাল করে ৫৭ কোটি টাকা দাবির অভিযোগও রয়েছে। ওই জালিয়াতির মামলায় শওকত হাসানের বিরুদ্ধে গত বুধবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। ঢাকার সিএমএম আদালতের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল হোসেন ওই মামলার আসামি শওকতের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত প্রতিবেদন (অভিযোগপত্র) আমলে নিয়ে এই পরোয়ানা জারি করেন।

এ ছাড়াও গুলশান থানাপুলিশ গত ২৩ ডিসেম্বর ইউআইটিএসের উপাচার্য ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনেককে হত্যার হুমকি দেওয়ায় শওকত হাসান মিয়া ও তার সশস্ত্র ক্যাডারদের বিরুদ্ধে দ-বিধির ৫০৬ ধারায় তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন আকারে ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি প্রসিকিউশন দাখিল করেন, যা বর্তমানে বিচারাধীন। শওকত হাসান মিয়া তার নিজ জেলা জামালপুর ও ঢাকায় বহু অপকর্ম করার কারণে সংক্ষুব্ধদের আবেদনের প্রেক্ষিতে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) তার বরাবর নোটিশ দিয়েছেন বলেও অ্যাডভোকেট মান্নান জানান।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877