মোস্তফা কামাল :
এখন পর্যন্ত করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার না করেও এ নিয়ে আঞ্চলিক রাজনীতি-কূটনীতিতে বেশ ফর্মে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিবেশীসহ কয়েকটি দেশের আমাদের নিয়ে টানাটানি চলছে। করোনা তথা করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। টানাটানিটা সীমা অতিক্রমের পর্যায়ে চলে না গেলেই মঙ্গল।
আবিষ্কারক বা উদ্যোক্তাদের ভ্যাকসিন কূটনীতির নয়ছয় ছকে ফেলার চেষ্টা চললেও ঠা-া মাথায় এগোচ্ছে বাংলাদেশ। কারণে-অকারণেই ঢাকাকে পাশে পেতে উতলা দিল্লি-বেইজিং। তাদের এই দ্বন্দ্বে টপ ফর্মে ঢাকা। গোটাবিশ্বেই দেশে দেশে করোনা নিয়ে রাজনীতি চলমান। করোনার চিকিৎসা, চিকিৎসা সামগ্রী, কিট, ভ্যাকসিন- সবকিছুই এখন কূটনীতির বিষয়। যে যার সাধ্যমতো চুটিয়ে চেষ্টা করছে এ কূটনীতির সুফল নিতে। ভ্যাকসিন কূটনীতির শিকার বাংলাদেশও। যে মুহূর্তে বাংলাদেশ থেকে বলা হয়েছে, করোনা এমনিতেই চলে যাবে, ভ্যাকসিন নাও লাগতে পারে- তখনই বাংলাদেশকে ভ্যাকসিনদানের প্রতিযোগিতা চীন-ভারতের।
ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে সবার আগে বাংলাদেশকে উপহার দেওয়ার ঘোষণা চীন দিয়ে রেখেছে শুরুতেই। এরই মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন, তাদের ভ্যাকসিনও আসবে শিগগিরই। প্রতিবেশীদের মধ্যে সবার আগে পাবে বাংলাদেশ। এ ভ্যাকসিন কূটনীতির মধ্যেই একেবারে ঝটিকা সাবজেক্ট সাপ্লাই দিয়েছে চীন। ১৫ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্মদিনে উপহার পাঠিয়ে নতুন খোরাক দিয়েছে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস। একদিকে সরকারের সঙ্গে বহুমাত্রিক কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের কর্মসূচি, আরেকদিকে খালেদা জিয়ার জন্মদিনে শুভেচ্ছা পাঠানোর এ চীনা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড কূটনৈতিক মহলে চরম ঝাঁকুনি দিয়েছে। এর দুই দিনের মাথায় ঝটিকা সফরকা- ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার। রীতিমতো হুলস্থূল ব্যাপার।
করোনার টিকা বা ভ্যাকসিন বাজারজাত কিংবা দান-অনুদানের রাজনীতি-কূটনীতি করতে গেলে বিশ্বের জনসংখ্যার হিসাব থাকা জরুরি। বিশ্বের বর্তমান জনসংখ্যা ৭৭৯ কোটি ৭৭ লাখ। সংখ্যার বিচারে সবার উপরে চীন। তাদের জনসংখ্যা প্রায় ১৪৪ কোটি। এর পর ভারত (১৩৮ কোটি)। আর জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের জনবহুল ২০ দেশের তালিকায় ৮ নম্বর অবস্থানে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৮ লাখের মতো। বাংলাদেশের আগে ক্রমানুসারে রয়েছে নাইজেরিয়া (প্রায় ২১ কোটি), ব্রাজিল (২১ কোটি), পাকিস্তান (২২ কোটি), ইন্দোনেশিয়া (২৭ কোটি) ও যুক্তরাষ্ট্র (৩৩ কোটি)। বাংলাদেশের পর ক্রমানুসারে থাকা রাশিয়া (প্রায় ১৫ কোটি), মেক্সিকো, জাপান, ইথিওপিয়া, ফিলিপাইন, মিসর, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশ রয়েছে জনসংখ্যায় সেরা ২০ দেশের তালিকায়।
করোনাকালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বিরোধ নতুন করে সবার মনোযোগ কেড়েছে। একই সময়ে চীন-ভারতের বিরোধের নতুন মাত্রা। ভারতের অভিযোগ, চীন যে কিট রপ্তানি করেছিল, তা ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু চীনের বক্তব্য- ভারত কিট ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারেনি। চীনকে যেভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে, তা দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ। করোনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে চীনের দুটি কোম্পানি থেকে প্রচুর কিট আমদানি করে ভারত। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তা বণ্টন করা হয়। কিন্তু কিট পৌঁছানোর কয়েকদিনের মধ্যেই রাজ্যগুলো বলতে শুরু করে, কিট ত্রুটিপূর্ণ। ওই কিটের সাহায্যে করোনা পজিটিভ রোগীর রক্ত পরীক্ষা করেও দেখা যাচ্ছে রিপোর্ট নেগেটিভ আসছে। বিষয়টি নিয়ে রাজ্যগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রের রীতিমতো সংঘাতও হয়। এর একপর্যায়ে চীনের কাছ থেকে আর কিট নেওয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় নরেন্দ্র মোদির সরকার। বিশাল জনসংখ্যা তথা বাজারের কথা মাথায় রেখে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কই টেনে নিতে চায় চীন। কিন্তু লাদাখ ও অরুণাচলে সীমান্ত নিয়ে বিতর্ক মাঝে মধ্যেই ওই সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। করোনার কিট নিয়ে নতুন বিতর্ক ওই টানাপড়েনে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বিশ্বায়ন ও ভূরাজনৈতিক কারণে চীন-ভারতের ভালো-মন্দ যে কোনো বিষয়ে গাছাড়া থাকতে পারে না বাংলাদেশ। কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। করোনার টিকা ইস্যুতে তা আরেকটু বেশি।
যে যেভাবেই দেখুক, ব্যাখ্যা করুক- ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। আর চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক। চীন আমাদের বিগ ট্রেড পার্টনার। ভারতও কম নয়। বাংলাদেশকে এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হয়, হচ্ছে। এর পাশাপাশি সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার কৌশলও নিতে হয়। ভারত-চীনের বিরোধ তাদের নিজস্ব সমস্যা। বাংলাদেশ এর আগে-পিছে নেই, পার্টও নয়। তবে পাটা-পুঁতার পিষাপিষিতে মরিচের দশায় টার্গেটে পড়ার ঝুঁকি থেকে যায়। দেশের গণমাধ্যমগুলোয় হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সফর দৃশ্যত বেশি আলোচিত ভ্যাকসিন কূটনীতি। কিন্তু সফরটি যে শুধু করোনাকেন্দ্রিক ছিল না, তা একেবারেই স্পষ্ট। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোয় এর বাইরেও কিছু কথা আসছে। সেখানে বলা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ার কারণে বাংলাদেশ ও নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রচেষ্টা জোরদার করেছে সাউথ ব্লক। এরই অংশ হিসেবে শ্রিংলা ছুটে এসেছেন বাংলাদেশে। ভারতীয় গণমাধ্যমের রিপোর্টে বলা হয়েছে, তিস্তা প্রকল্পে একশ কোটি ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও জোরদার হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমের জন্য বাংলাদেশ তিস্তায় জলাধর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ওই জলাধার নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে চীন এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। খবরটি ভারতের কাছে অস্বস্তির। এ রকম জলাধার নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশে যেমন শুকনো মৌসুমে পানির সমস্যা হবে না, ঠিক তেমনি ভারতের কাছেও তিস্তার পানি নিয়ে বাংলাদেশের ধরনা দিতে হবে না।
করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশের নিজ থেকে রাজনীতি-কূটনীতি করা জরুরি নয়। বাংলাদেশ চীন থেকে ভ্যাকসিন নেবে। ভারত থেকেও নেবে। এ রকম সময়ে বাংলাদেশ প্রশ্নে আবার তৎপর পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওপার বাংলার ইলিশ আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ ওঠায় বিধানসভায় তিনি বাংলাদেশকে তিস্তার জল দিতে না পারার আফসোস করেছেন। বিধানসভায় দাবি তুলে বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আলোচনার ভিত্তিতে নদীকেন্দ্রিক সমস্যার সমাধান করতে হবে। করোনার ভ্যাকসিন কূটনীতির সময় মমতার এভাবে তিস্তা নিয়ে সরব হওয়াকে মামুলি বা বাতকে বাত বলার সুযোগ আছে?
বাংলাদেশে চীনের সাম্প্রতিক আরও কিছু বিনিয়োগ ভারতের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কও নতুন মাত্রা লাভ করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে চীনা অংশীদারিত্ব বাড়ছে। করোনা সংকটেও ভারতের চেয়ে বেশি সহযোগিতা করছে চীন। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, চীন-ভারত দ্বন্দ্বে সর্বোচ্চ সতর্ক বাংলাদেশ। কারও পক্ষেই অবস্থান স্পষ্ট না করে এগোচ্ছে কৌশলী পথে। নিজের স্পর্শকাতর অবস্থা বিবেচনায় দিল্লি-বেইজিং সম্পর্কে ঢাকার এ সতর্ক অবস্থান। দুই বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়ে কৌশলে খেলতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ কেন নিষ্ক্রিয় ‘ভিক্টিম’ থাকবে, বরং নিজের কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে এগোচ্ছে।
চীন-ভারত উভয় দেশই কেন বাংলাদেশকে হালে বেশি পাত্তা দিচ্ছে, এর রহস্য জানে-বোঝে ঢাকা। রপ্তানি পণ্যের জন্য চীন তাদের বাজার খুলে দিতে চায় বাংলাদেশকে। ভারতও দিতে চায় অনেক কিছু। এশিয়ার সবচেয়ে বড় এ দুই পরাশক্তি চীন-ভারতের দ্বন্দ্ব গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির গতি-প্রকৃতি পাল্টে দিতে বসেছে। এর মধ্যে চিড়েচ্যাপ্টা জায়গায় বাংলাদেশ। আবার বাংলাদেশের ভ্যালু অন্যদের চেয়ে আলাদা বিবদমান দুই দেশের কাছে। দুটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের গাঁথুনি বেশি। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুটি দেশই সুবিধাজনক অবস্থানে। দুটি দেশেরই বিপুল বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বাংলাদেশের সঙ্গে। বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতেও ব্যাপক প্রতিযোগিতা তাদের। দুটি দেশই বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে ব্যাপক সাহায্যের প্রস্তাব দিচ্ছে। বাংলাদেশে বড় আকারে রেল প্রকল্পে আগ্রহী দুটি দেশই। গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনেও ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে উভয় দেশের। করোনার ভ্যাকসিন সেটিতে একটি মোড়ক দিয়েছে মাত্র। ভ্যাকসিনকে ইস্যু করলেও টার্গেট অন্যখানে। মুখে ভ্যাকসিন আর বগলে অন্য কিছু নিয়ে চীন-ভারত যেভাবে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে, এর জের কোথায় গিয়ে ঠেকবে- তা এখনো বলা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশকে থাকতে হচ্ছে সাবধানি, ভারসাম্য রক্ষায় হতে হচ্ছে চুলচেরা হিসাবি।
মোস্তফা কামাল : কলাম লেখক