রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ১০:১০ পূর্বাহ্ন

হোতা গ্রেপ্তারের পরও মেডিক্যালের প্রশ্নফাঁস ঠেকানো যায়নি

হোতা গ্রেপ্তারের পরও মেডিক্যালের প্রশ্নফাঁস ঠেকানো যায়নি

স্বদেশ ডেস্ক:

প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার তিন দিন আগে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন প্রশ্নপত্র ফাঁসচক্রের মূল হোতা জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া। তার পরও সেই প্রশ্নফাঁস ঠেকানো সম্ভব হয়নি। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই জসীমের ভায়রাভাই সামিউল জাফর একসেট প্রশ্ন নিয়ে পালিয়ে যান।

পরে সেই প্রশ্নপত্র জসীমের স্ত্রী শারমিন আরা জেসমিন শিল্পী মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রেই ওই বছর ভর্তি পরীক্ষা হয়েছিল। পাঁচ বছর পর সম্প্রতি জসীম উদ্দিনসহ এ সিন্ডিকেটের পাঁচ সদস্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জানা গেল এসব তথ্য। পাঁচ বছর আগের সেই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় সারাদেশে আন্দোলন হয়েছিল। এমনকি ফল বাতিলের দাবিতে হাইকোর্টে রিটও করা হয়েছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনড় থাকায় জালিয়াতি করে অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

একটি গোয়েন্দা সূত্র বলছে, জসীমের নেতৃত্বে ভয়ঙ্কর এ সিন্ডিকেট ১৪ বছর ধরে মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। চক্রের হোতা জসীম উদ্দিনের খালাতো ভাই আবদুস সালাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ছাপাখানার মেশিন-ম্যান। ওই ছাপাখানা থেকেই মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন জসীমের কাছে পৌঁছে দিতেন। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে ২০০৬ সালে সালামকে সেই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়। কিন্তু কিছুদিন পর সে আবার সেই পদে ফিরে আসেন। ২০১১ সালে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে জসীম উদ্দিন একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তখনো প্রশ্নফাঁসে সালামের নাম উঠে এসেছিল। তার পরও প্রশ্ন ছাপানোর সময় তাকে রাখা হতো। সালাম প্রশ্নফাঁস করছেন এ বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ে অনেকটা ওপেন সিক্রেট ছিল। তাদের আশ্রয়দাতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে।

সিআইডির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, জসীমের নেতৃত্বে ভয়ঙ্কর পারিবারিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের প্রশ্নফাঁস হচ্ছে। জসীমের খালাতো ভাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেশিনম্যান আবদুস সালাম প্রশ্ন ছাপানোর সময় তা ফাঁস করতেন। জসীম উদ্দিন সেই প্রশ্নপত্র সারাদেশে ছড়িয়ে দিতেন। সারাদেশে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির একটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতের তার ঘনিষ্ঠজনরা। এর মধ্যে রয়েছেন তার ভাতিজা পারভেজ খান, বোনজামাই জাকির হোসেন দীপু, ভায়রাভাই সামিউল জাফর, দুলাভাই আলমগীর হোসেন, স্ত্রী শারমিন আরা জেসমিন শিল্পী এবং ভাগ্নে রবিন। প্রশ্নপত্র ফাঁস করার বিনিময়ে প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তারা হাতিয়ে নিতেন ১০-১২ লাখ টাকা। এভাবে সালাম কোটিপতি হয়েছেন। করেছেন বাড়ি, গাড়ি ও ফ্ল্যাট। ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন শতাধিক।

সিআইডির এএসপি সুমন কুমার দাস বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেস থেকেই মেডিক্যাল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বারবার ফাঁস হয়েছে। প্রেসের মেশিনম্যান সালাম ও তার খালাতো ভাই জসীম দেশব্যাপী একটি চক্র গড়ে তুলেছেন। তাদের মাধ্যমে শত শত শিক্ষার্থী অর্থের বিনিময়ে মেডিক্যাল কলেজ ভর্তি হয়েছেন। আমরা এই পুরো চক্রটি চিহ্নিত করেছি। অনুসন্ধান এখনো চলমান রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে সালামকে মেশিনম্যানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় কিছুদিন পর আবার সালামকেই আগের দায়িত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপানোর সময় সালামকে ছাপাখানায় প্রবেশ করানো হতো। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি জানালেও কোনো কাজ হয়নি। কারণ সালামের পেছনে শক্তিশালী ব্যাকআপ রয়েছে। তাই তার বিরুদ্ধে কখনই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বরং প্রশ্নফাঁসের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে একাধিকবার গ্রেপ্তার সালামের খালাতো ভাই জসীস অবাদে ছাপাখানায় আসা-যাওয়া করতেন।

সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, ছাপাখানা থেকে প্রশ্নফাঁসের মূল কারিগর সালামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের তালেবপুর ইউনিয়নের কাশিপুরে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেসের মেশিনম্যান হিসেবে ১৯৮৮ সালে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি একই পদে কাজ করছেন। কয়েকদফায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠলেও তিনি একই পদে বহাল আছেন।

আন্দোলন, রিটেও বাতিল হয়নি পরীক্ষার ফল : এদিকে ২০১৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা হয়। এর তিন দিন আগে ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মহাখালী থেকে প্রশ্নফাঁস চক্রের মূল হোতা জসীম উদ্দিনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের এক কোটি ২১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা সমমূল্যের বিভিন্ন ব্যাংকের ১৩টি চেক ও নগদ ৩৮ হাজার টাকা, দুটি মডেল প্রশ্নের ৮৮ কপি প্রশ্ন ও উত্তরপত্র উদ্ধার করা হয়। প্রশ্নফাঁস চক্রের মূল হোতাকে গ্রেপ্তার করা হলেও সে বছর ঠেকানো যায়নি প্রশ্নফাঁস। সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা হওয়ায় এ নিয়ে সারাদেশে আন্দোলন শুরু হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তড়িঘড়ি করে ফলও প্রকাশ করে। এ ফল বাতিলের দাবিতে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন একজন আইনজীবী। তবে সেই পরীক্ষার ফল বাতিল করা হয়নি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877