স্বদেশ ডেস্ক:
মো. মোর্শেদুল ইসলাম ওরফে মোর্শেদ। চাকরির সন্ধানে পথে পথে ঘুরছিলেন বেকার এ যুবক। হঠাৎ তার সঙ্গে এক ব্যক্তির পরিচয় হয়। নতুন পরিচয় হওয়া ব্যক্তি কাজও দিলেন মোর্শেদকে, কিন্তু সেই কাজের জন্যই আজ তিনি জেলখানায়। শুধু তাই নয়, মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে মোর্শেদের।
মোর্শেদের জেলে যাওয়ার কারণ ওই ব্যক্তি মোর্শেদকে যে কাজ দিয়েছিলেন তা ছিল ইয়াবা পরিবহনের। মোর্শেদকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় মাদক বহনের কাজ দিয়েছিলেন তিনি। প্রতি পিস ইয়াবা বহন করলে মিলবে এক টাকা। সেই হিসেবে ১০ হাজার পিস ইয়াবার এক চালানেই মিলবে ১০ হাজার টাকা।
বেকার মোর্শেদ ১০ হাজার টাকা উপার্জনের লোভ পড়ে যান। এই লোভে পড়ে তিনি ১০ হাজার পিস ইয়াবা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এনেছিলেন। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই ধরা পড়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে।
১০ হাজার পিস ইয়াবার চালানসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর ৩৬(১) ১০(গ)/৪১ ধারায় দায়ের করা মামলায় তিনি এখন জেলহাজতে।
উদ্ধারকৃত ওই ইয়াবার ওজন ছিল ৯৮০ গ্রাম। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, ইয়াবার পরিমাণ ৪০০ গ্রাম বা তার বেশি হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে।
গ্রেপ্তারের আগে মোর্শেদ হয়তোবা নিজেও জানতেন না যে, ১০ হাজার টাকার জন্য ইয়াবা বহন করে তার মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিও হতে পারে। শুধু মাত্র মোর্শেদই নয়, তার মতো এমন অনেক যুবকই জেনে বা না জেনে যুক্ত হয়েছেন ইয়াবা ব্যবসায়। আইনশৃখলা বাহিনীর সদস্যরা প্রায় প্রতিদিনই এমন ইয়াবার চালানসহ অনেক মাদক ব্যবসায়ীদের আটক করছেন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোর্শেদের মত যারা ধরা পড়ছে তারা সামান্য কিছু টাকার জন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সমাজে যারা মোর্শেদদের পেছনে কাজ করে অর্থাৎ মাদকের গডফাদার তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। না হলে এমন অল্প টাকার লোভ দেখিয়ে প্রতিনিয়তই সমাজে হাজারও মোর্শেদের জন্ম দেবেন তারা।
যেভাবে গ্রেপ্তার হলেন মোর্শেদ
মোর্শেদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের লালবাগ বিভাগের একটি দল বংশাল থানা এলাকার হোটেল বায়তুল সমীর ইন্টারন্যাশনালের সামনে থেকে মোর্শেদকে আটক করে। পরে তার কাঁধে ঝুলানো একটি স্কুল ব্যাগ থেকে ১০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। যার মোট ওজন ৯৮০ গ্রাম। ওই মামলায় ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়া আরও দুজনকে আসামি করা হয়েছে।
শাস্তি সম্পর্কে যা বললেন আইনজীবী
মোর্শেদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী শুভ্র সিনহা রায় বলেন, ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ইয়াবা বলতে কোনো শব্দ নেই। ইয়াবা তৈরি উপাদান হলো অ্যামফিটামিন। অ্যামফিটামিনের পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেটের মধ্যে কি পরিমাণ আছে তার ওপর আদালতে বিচার হয়।’
তিনি বলেন, ‘ইয়াবা বা অ্যামফিটামিনের উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন বা পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আইনে বলা হয়েছে—১০০ গ্রাম পর্যন্ত ইয়াবা পাওয়া গেলে ১ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে। এ ছাড়া ইয়াবার পরিমাণ ১০০ থেকে ২০০ গ্রামের মধ্যে হলে ৫ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে। ইয়াবার পরিমাণ ২০০ গ্রাম বা তার বেশি হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে।’
ওই আইনজীবী বলেন, ‘ইয়াবা সরবরাহ, বিপণন, কেনা-বেচা, হস্তান্তর, গ্রহণ-প্রেরণ, লেনদেন, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- ২০০ গ্রাম পর্যন্ত ইয়াবা পাওয়া গেলে ১ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে। ইয়াবার পরিমাণ ২০০ থেকে ৪০০ গ্রামের মধ্যে হলে ৫ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে। ইয়াবার পরিমাণ ৪০০ গ্রাম বা তার বেশি হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে। এ ছাড়াও ইয়াবা সেবনের শাস্তি ৩ মাস থেকে ২ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড।’
সমাজকে একটা বার্তা দিতে চাই
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) রাজীব আ. মাসুদ বলেন, ‘মোর্শেদকে বংশাল থানা এলাকার নর্থ সাউথ রোডের হোটেল বাইতুল সমীর ইন্টারন্যাশনালের সামনে থেকে ১০ হাজার পিচ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ইয়াবার চালানটি কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে চট্টগ্রামে আনা হয়েছে। এরপর মোর্শেদের মাধ্যমে তা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আর এই ১০ হাজার পিস ইয়াবা ঢাকায় নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিতে পারলে মোর্শেদ পেতেন ১০ হাজার টাকা। সামান্য কিছু টাকার লোভেই তিনি ইয়াবা বহন করেছেন।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এই ঘটনা থেকে সমাজকে একটা বার্তা দিতে চাই। ১০ হাজার পিস ইয়াবার জন্য মাত্র ১০ হাজার টাকা পেত মোর্শেদ। কিন্তু এটা যে কতটা ভয়ংকর অপরাধ ; আদালতের রায়ে তার মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। এই বার্তাটা আসলে সমাজে পৌঁছানো খুবই জরুরি।’
পরিণতি সঠিকভাবে আঁচ করতে পারে না
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘কোনো মাদকের যখন চাহিদা থাকে। তখন যারা মূল মাদক ব্যবসায়ী তারা যেকোনো মূল্যেই তা সেবনকারীর হাতে পৌঁছ দেওয়ার চেষ্টা করেন। আমাদের দেশে দীর্ঘ সময় ধরেই ইয়াবা সেবনকারী একটা গোষ্ঠী তৈরী হয়েছে। বিশেষ করে ইয়াং জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা। করোনাকালেও কিন্তু তাদের ইয়াবা সেবন বন্ধ হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে গেছেন। অনেকের আয়ও কমেছে। তাই বাড়তি টাকা উপার্জনের লোভ দেখিয়ে হয়তোবা অনেক মানুষকেই ইয়াবা চালানের কাজে লাগাচ্ছেন মাদকের গডফাদাররা। অনেক ক্ষেত্রে এটাও দেখা যায়, কেউ হয়তো ইয়াবা সেবনই করেন না। কিন্তু শুধু মাত্র টাকার জন্য ইয়াবা বহন করছেন। হয়তোবা নিজের জীবনের তাগিদে অনেকেই এই কাজে জড়িয়েছেনতারা জানেনও এটা একটা অপরাধ। কিন্তু এর শাস্তি বা পরিণতি অনেকেই হয়তো সঠিকভাবে আঁচ করতে পারেন না।’
আইনশৃখলা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে ঢাবির এ শিক্ষক বলেন, ‘মাদকের সঙ্গে জড়িতদের আইনগতভাবে অবশ্যই সাজা দিতে হবে। তবে আইনশৃখলা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ তারা যেন এর পেছনের দিকগুলোও খুঁজে বের করেন। শুধু মাত্র অর্থের জন্য যারা মাদক বহনের কাজ করছেন বা মাদকে জড়াচ্ছেন তাদের বিষয়গুলোও ভালোভাবে পর্যালোচনা করা। আইনের আওতায় আনার পরেও মানবিক দৃষ্টিতে দেখার একটা পরিবেশ তৈরি করা যেতে পারে। একই সঙ্গে কাউন্সিলিং করতে হবে। ”
তিনি বলেন, ‘এ দেশকে মাদক মুক্ত করতে হলে মুল মাদক ব্যবসায়ীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে মোর্শেদের মতো অনেকেরই টাকার দরকার হবে। আর তাদেরই লোভ দেখিয়ে মাদকের পথে টেনে আনবেন এসব মূল মাদক কারবারিরা।’