শনিবার, ২৫ মে ২০২৪, ০১:১১ অপরাহ্ন

কিশোরীর ডাকে গল্পকেও হার মানাল তুরস্ক

কিশোরীর ডাকে গল্পকেও হার মানাল তুরস্ক

সময় মাত্র সাত থেকে আট ঘণ্টা। জীবন-মরণ সমস্যায় থাকা একজন রোগীর জন্য এটি অনেক লম্বা হলেও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার জন্য নেহাত সামান্য। নাটকীয়ভাবেই ঘটেছে ঘটনাটি। দেশের বাইরে থাকা এক কিশোরীর ডাকে সাড়া দিয়ে তার বাবার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছে ইউরোপীয় মুসলিম দেশ তুরস্ক।
পরিবারের সাথে লেয়লা গুলুসকেন নামের ওই কিশোরী থাকেন সুইডেনে। সেখানেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন তার বাবা তুরস্কের নাগরিক ইমরুল্লাহ গলুসকেন। লেয়লা সংবাদমাধ্যমকে জানান, তার বাবা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এমন সন্দেহ হলে চিকিৎসককে খবর দেয়া হয়। বাড়িতে একজন চিকিৎসক আসেন। বাবাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

হাসপাতালে নেয়ার পর লেয়লার বাবার শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। কিন্তু ডাক্তার হাসপাতালে ভর্তি না করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এরপর ভালো চিকিৎসা করাতে মরিয়া হয়ে ওঠে পরিবার। কিন্তু লেয়লাদের মনে হতে থাকে সুইডেনের হাসপাতালে তার বাবাকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। ঠিকভাবে চিকিৎসাও দেয়া হচ্ছে না। নিজ দেশের ওপর প্রবল আস্থা লেয়লার। দেশটির নেতা রজব তাইয়েব এরদোগানের প্রতি তার প্রচণ্ড বিশ্বাস। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পরিবারের এই কঠিন সময়ে দেশের কাছে প্রিয় নেতার কাছে কিছু চাইবেন। প্রবাসে থেকেই তিনি বাবার স্বাস্থ্যের অবস্থা জানিয়ে টুইটারে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। এতে তিনি তার বাবার সর্বশেষ অবস্থা জানান এবং বলেন, সুইডেনে তারা ঠিকভাবে চিকিৎসা পাচ্ছেন না। ২১ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে তিনি দেশকে পাশে পাওয়ার আবেদন জানান।

লেয়লার বোন সামিরা গুলুসকেন ভিডিওটি শেয়ার দেন। সেখানে সামিরা লিখেন, আমরা আমার পরিবারের সাথে সুইডেনে থাকি। আমার বাবার ১১ দিন আগে জ্বর হয়। সাথে শ্বাসকষ্ট। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে ডাক্তার ডাকলাম। কিন্তু তারা আমাদের যাকে সাড়া দিলো না। পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন অনেকবার ফোন করেছি। কিন্তু তারা আসেনি। এরপর তিনি সাহায্যের আবেদন জানান।

লেয়লার এই অনুরোধ নজরে আসে তুরস্কের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা: ফাহরুদ্দিন খোজার। তিনি তার ভেরিফায়েড আইডি থেকে লেয়লার অনুরোধে সাড়া দিয়ে লেখেন, ‘প্রিয় লেয়লা, আমরা তোমাকে শুনতে পেয়েছি। বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আমরা সুইডেনে আসছি। সকাল ৬টায় আমরা রওয়ানা দিচ্ছি। এমন সময় আমি দূরে থাকার জন্য দুঃখিত। তুরস্কের হাসপাতাল ও চিকিৎসক তোমার বাবার চিকিৎসা করতে প্রস্তুত। আমাদের প্রেসিডেন্টের শুভেচ্ছা নিও। তুরস্কের সব মানুষের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি অনেক ভালোবাসা।’

এর পর সুইডেনের মালমো বিমানবন্দরে পৌঁছায় জিএমটি ০৭০০ বিমান। সুইডেন থেকে করোনায় আক্রান্ত ৪৭ বছর বয়সী ইমরুল্লাহ গলুসকেন এবং তার তিন কন্যাকে দেশে ফিরিয়ে নেয়া হয় মাত্র সাত থেকে আট ঘণ্টার ব্যবধানে। পরে শুরু হয় চিকিৎসা তৎপরতা। রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পর ইমরুল্লাহ গলুসকেন এবং তার তিন কন্যাকে আঙ্কারার ইহির হাসপাতালে নেয়া হয়।

তুরস্কের এমন পদক্ষেপে মুগ্ধ হন লেয়লা গুলুসকেন। সেইসাথে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ঘটনাটি ফলাও করে প্রচার হওয়ায় প্রশংসার জুয়ারে ভাসতে থাকে দেশটি। এর বিপরীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হতে থাকে সুইডেন সরকারের। দেশে ফেরার পর লেয়লা টুইটে লিখেন, ‘আমি জানতাম আমার দেশ আমাকে সমর্থন করবে। এই কঠিন সময়ে দেশ আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফাহরুদ্দিন খোজাকে ধন্যবাদ জানাই। আল্লাহ আমাদের দেশকে রক্ষা করুন।’

লেয়লা আরো লিখেন, ‘তুরস্কের নাগরিক হিসেবে আমি গর্বিত। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন আমার টুইটের জবাব দিয়েছেন, এর পর থেকে তুর্কি কর্মকর্তারা আমার সাথে অনবরত যোগাযোগ করে গেছেন। আল্লাহ আমাদের দেশকে রক্ষা করুন।’

গলুসকেন ও তার পরিবারকে বহনকারী এই বিশেষ ফ্লাইট দেশে ফেরার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী খোজা লেয়লাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘ওই কন্যা যা করেছে, সেটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। তার আহ্বানে আমরাও দ্রুত সাড়া দিয়েছিলাম।’

তুরস্কের যোগাযোগ পরিচালক ফাহরুদ্দিন আলতুন এক টুইটে বলেন, ‘তুরস্কের নাগরিক ইমরুল্লাহ গলুসকেন সুইডেনে ভাইরাসে পজিটিভ ধরা পড়লেও তার চিকিৎসা হয়নি। আমরা তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তুরস্কে নিয়ে এসেছি।’

ইমরুল্লাহ গলুসকেনের নিবিড় চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসার নিয়মিত খোঁজ-খবর নিচ্ছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট স্বয়ং।

তুরস্কের গণমাধ্যম আনাদোলু ও ইয়ানি শাফাক জানিয়েছে, দেশে ফেরার পর লেয়লার সাথে ফোনে কথা বলেছেন এরদোগান। ২৬ এপ্রিল তিনি একটি টুইটবার্তায় বলেন, ‘আজ আমি আমার বোন লেয়লার সাথে টেলিফোনে আলাপ করেছি। লেয়লা ইমরুল্লাহর মেয়ে। তাকে আমরা সুইডেন থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে নিয়ে এসেছি।’
ফোনে এরদোগান লেয়লাকে বলেন, ‘আপনার বাবা তুরস্কে পৌঁছেছেন। আমি আশা করি আমাদের সহকর্মীরা তাকে সুস্থ করে তুলবেন। আল্লাহ তাকে নিরাময় দেবেন। আপনি চিন্তা করবেন না।’ জবাবে লেয়লা বলেন, ‘আপনি যা করেছেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি আপনার সাথে কথা বলতে পেরে খুশি। আমি আমাদের দেশ এবং আপনাকে নিয়ে গর্বিত। আমার বাবাকে দেশে নিয়ে আসায় কৃতজ্ঞ। যারা এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন, তাদের ধন্যবাদ। আমরা বেঁচে আছি বলে আনন্দিত।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877