পাসপোর্ট ছাড়াই গত ৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনের উদ্দেশে বিমানের একটি ফ্লাইট নিয়ে কাতারের দোহায় চলে গিয়েছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সিনিয়র একজন পাইলট। এর জেরে সেখানে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তাকে। সে দেশের গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পর দেশেও এ নিয়ে শুরু হয় নানান সমালোচনা।
এ কা-ের জেরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ তাদের ফ্লাইট পরিচালনায়, বিশেষ করে ভিভিআইপি অর্থাৎ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বহনকারী ফ্লাইটের নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যে ব্যর্থ, ফের তা প্রতীয়মান হয়েছে। সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ভিভিআইপিদের বহনকারী ফ্লাইটের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনাও প্রদান করে থাকে।
এসব নির্দেশনা যে বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে উপেক্ষিত; তারা যে দায়িত্ব পালনে এবং সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনে ব্যর্থ, সেই বার্তাও ওঠে এসেছে। সর্বশেষ, পাইলটের কা-ে বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে ‘ভুল’ হয়েছে। কিন্তু বিমানের এমন একের পর এক ভুল সহজভাবে নিচ্ছে না গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এর নেপথ্যে শুধুই উদাসীনতা নাকি বড় কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে?Ñ এমন প্রশ্নকে সামনে রেখে বিমানের ভুলের দিকে গভীর নজর রাখছেন গোয়েন্দারা।
এদিকে পাসপোর্ট ছাড়াই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট ফজল মাহমুদ কাতার পর্যন্ত চলে যাওয়ার ঘটনায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের এসআই কামরুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে পুলিশের বিশেষ শাখা। পাসপোর্ট না দেখেই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট ফজল মাহমুদকে কাতারে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার ঘটনায় তাকে গতকাল শনিবার বরখাস্ত করা হয়।
পুরো ঘটনা তদন্তে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি দুটি আজ থেকে কাজ শুরু করবে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ ভিভিআইপি অর্থাৎ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের বিধি রয়েছে। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিরাপত্তা পরামর্শ পদে পদে উপেক্ষা করছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ।
এ প্রবণতা দিন দিন বেড়ে এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। পাইলটের এই পাসপোর্ট কা-ের কিছুদিন আগে অর্থাৎ গত ২৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিন দেশীয় সফরের প্রাক্কালে নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে তাকে বহনকারী ফ্লাইট থেকে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের প্রতিনিধি ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (গ্রাহক সেবা) আতিক সোবহানকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অথচ তিনি আগে থেকেই কালো তালিকাভুক্ত ছিলেন।
শুধু সরকারপ্রধানের ভ্রমণের ক্ষেত্রেই বিব্রতকর এ দুটি ঘটনায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ভিভিআইপিদের ভ্রমণকালীন নিরাপত্তার বিষয়টি ফের সামনে চলে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর ভ্রমণকালে বিমানকর্মীদের প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার নিরাপত্তাবিষয়ক যেসব নির্দেশনা রয়েছে, এসবের ধারাবাহিক উপেক্ষা এবং একের পর এক ‘ভুল’ করা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছেÑ এসব কি বিমান কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা কিংবা অবহেলা? না দায়িত্বে গাফিলতি? নাকি সচেতন কোনো ‘ভুল’ অর্থাৎ ষড়যন্ত্রের অংশ?
এসব খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন। বিমান সূত্র জানায়, বিমানের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (গ্রাহক সেবা) আতিক সোবহান ২০১৪ সালে জিএম (এয়ারপোর্ট সার্ভিস) পদে থাকাকালীন সময়েও প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ফ্লাইট থেকে তাকে নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে কালো তালিকাভুক্ত করে নামিয়ে দেওয়া হয়।
তখন সরকারি সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেপালের কাঠমান্ডুতে যাচ্ছিলেন ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ভিভিআইপি ফ্লাইটে কর্তব্য পালনে আতিক সোবহানের ওপর সে সময় আরোপিত সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল আছে। এর পরও সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর তিন দেশ সফরকালে তার সফরসঙ্গী হিসেবে আতিক সোবহানের নাম প্রস্তাব করে বিমান কর্তৃপক্ষ, যা খুবই রহস্যজনক।
বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার নজর পড়ায় ফ্লাইট থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় বর্তমানে বিমানের এই ভারপ্রাপ্ত পরিচালককে। এদিকে পাসপোর্ট ছাড়াই পাইলটের বিদেশযাত্রার ঘটনার রহস্য উদঘাটনে আজ থেকে কাজ শুরু করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের তদন্ত কমিটি। ঘটনাটি গাফিলতি, নাকি কোনো ধরনের পরিকল্পনার অংশ, সেটি খতিয়ে দেখার পাশাপাশি ফজল মাহমুদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছে বিভিন্ন সংস্থা।
দেশে ফেরত আনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় তার পাসপোর্ট কাতার পাঠিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যদিও ঘটনাটি ইচ্ছেকৃত নয়, ‘ভুলবশত’ হয়েছে বলে দাবি করেছেন সিনিয়র পাইলট ফজল মাহমুদ। ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর হাঙ্গেরি যাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোয়িং-৭৭৭ উড়োজাহাজটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাদে জরুরি অবতরণ করে।
এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এরও আগে এ ঘটনার জেরে একই বছরের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ বিমানের ৬ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে সে বছরেরই ২০ ডিসেম্বর বিমানের পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটেরিয়েল ম্যানেজমেন্ট) উইং কমান্ডার (অব) এমএম আসাদুজ্জামান বাদী হয়ে মামলা করেন।
এরপর গত বছরের ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে বিমানের প্রকৌশলী নাজমুল হকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলার নির্দেশ দেন আদালত। এর আগে ১১ জনের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, অবহেলা ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রমের অভিযোগে করা মামলা থেকে সবাইকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পাসপোর্ট ছাড়াই পাইলট ফজল মাহমুদের কাতার যাত্রার প্রসঙ্গে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, আমরা জানতে পেরেছি পাইলট (ফজল মাহমুদ) ভুল করে পাসপোর্ট নেননি।
তবে তার এমন ভুল করা উচিত হয়নি যেহেতু এটি প্রধানমন্ত্রীর বিমান। ইমিগ্রেশন পুলিশেরও উচিত ছিল পাসপোর্টটি দেখা। কর্তব্যে গাফিলতির কারণে একজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, পাইলট ভুল করেই এমনটা করেছেন। বিমানবন্দরে দুই-তিন জায়গায় চেক হয়। তারপরও উনি চলে গেছেন। আমাদের ইমিগ্রেশনে তিনি ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়েছেন। ইমিগ্রেশন পুলিশ জেনারেল ডিক্লারেশন দেখেছেন।
পাসপোর্ট দেখতে চাইলে সব সময় পাইলটরা বলেন, পকেটে আছে। এর পরও আমাদের ইমিগ্রেশন পুলিশের গাফিলতির কারণে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যে সাসপেন্ড করেছেন পুলিশপ্রধান। এখানে গাফিলতি হয়েছে। তবে আমি বলব, এটা প্রধানমন্ত্রীর বিমান, তাই এই ভুলটা করা পাইলটের উচিত হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা তদন্ত করছি। তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে।
বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার দিন পাইলট ফজল মাহমুদের কাছে দায়িত্বরত ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা পাসপোর্ট চেয়েছিলেন। এর জবাবে পাইলট জানিয়েছিলেন, পাসপোর্ট তার ব্যাগে রয়েছে। তিনি সিনিয়র পাইলট এবং সবসময় যাওয়া-আসা করেন বিধায় তার কথা দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা বিশ্বাস করেছিলেন। এটা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। বিমানের জেনারেল ডিক্লারেশন (জিডি) দেখেই ইমিগ্রেশন করা হয়।
এ সময় প্রুফ হিসেবে পাসপোর্ট দেখা হয়। এখানে দুজনেরই সমান দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই ইতোমধ্যেই ইমিগ্রেশনের এসআই কামরুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে সদর দপ্তরে রিপোর্ট জমা দিয়েছি।