বৃহস্পতিবার, ১৩ Jun ২০২৪, ১০:৪৩ পূর্বাহ্ন

চাকরির লোভে ভারতের মুসলিম যুবকের করুণ পরিণতি

চাকরির লোভে ভারতের মুসলিম যুবকের করুণ পরিণতি

স্বদেশ ডেস্ক:

চাকরি খুঁজছিলেন হায়দরাবাদের বাসিন্দা মুহাম্মদ আসফান। কাজ খুঁজতে গিয়েই তিনি পৌঁছে যান রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে। তবে সেটাই যে তার জীবনের শেষ কয়েক দিন হবে, তার আন্দাজ তিনি কখনোই পাননি।

আসফান রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেখানেই যে তার মৃত্যু হয়েছে, তা নিশ্চিত করেছে রাশিয়ায় ভারতীয় দূতাবাস।

বুধবার রাশিয়ায় ভারতীয় দূতাবাস তাদের সামাজিক মাধ্যমে লিখেছে, ‘আমরা ভারতীয় নাগরিক মুহাম্মদ আসফানের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পেয়েছি। আমরা তার পরিবার ও রুশ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রাখছি। আমরা তার লাশ ভারতে পাঠানোর চেষ্টা করছি।’

এর আগে ইসরাইলে হেজবুল্লাহর হামলায় এক ভারতীয় নিহত হন।

রাশিয়ায় ওই ভারতীয়র মৃত্যুর খবর এমন সময়ে এলো, যখন রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন, এরকম কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় নাগরিকের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

সেই খবর সামনে আসার পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, রুশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং ওই সব নাগরিককে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৯ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছিল যে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় নাগরিক মস্কোর ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করে সাহায্য চেয়েছেন।

আসফানের সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে?
হায়দরাবাদ শহরের বাসিন্দা ছিলেন মুহাম্মদ আসফান। আসফান তার স্ত্রী আসমা শিরিন এবং একটি ছোট সন্তান রেখে গেছেন। আসফানের বয়স ছিল ৩০ বছর।

তার পরিবারের সাথে কথা বলেছে ভারতের এনডিটিভি। প্রতিবেদনে বলা হয়, হায়দরাবাদে একটি পোশাকের শোরুমে কাজ করতেন আসফান।

তার ভাই মুহাম্মদ ইমরান ফিনান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, ‘বাবা ভ্লগস’ নামের এক ইউটিউবারের ভিডিও দেখে তার ভাই এই ফাঁদে পড়েন।’

ইমরানের কথায়, ‘বাবা ভ্লগস’-এর ওই ইউটিউবার দাবি করতেন, মস্কোতে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে কাজ করার সুযোগ রয়েছে এবং এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে রাশিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ‘বাবা ভ্লগস’ ইউটিউব চ্যানেল থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়, যেখানে বলা হয়েছিল, রাশিয়ায় ডেলিভারি বয়ের চাকরি আছে।

দ্বিতীয় ভিডিওতে রুশ সেনাবাহিনীতে ‘সহকারী’র চাকরির কথা বলা হয়েছিল।

পিটার্সবার্গ শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ওই ইউটিউবার রাশিয়ার আবহাওয়ার প্রশংসা করে বলছিলেন, মাসে এক লাখ টাকা বেতনে রুশ সেনাবাহিনীতে চাকরি খালি আছে।

তার আরো দাবি ছিল যে তিন মাসের প্রশিক্ষণ এবং বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হবে।

মুহাম্মদ ইমরানের কথায়, ‘এ ধরনের ভিডিওতে যে সব দাবি করা হয়েছিল, আমার ভাই আসফান সেই ফাঁদেই পা দেন।’

আসফানের পরিবার আর কী বলছে?
ফিনান্সিয়াল টাইমসকে মুহাম্মদ ইমরান বলেন, ভাইকে খুঁজতে চলতি সপ্তাহে রাশিয়ায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি।

তার কথায়, ‘ভাই ফেঁসে গিয়েছিল। গত বছরের নভেম্বরে রাশিয়ায় পৌঁছান তিনি। তাকে রুশ ভাষায় লেখা একটি চুক্তিতে সই করানো হয়। এরপর ডিসেম্বরে তাকে ইউক্রেন সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর থেকে ভাইয়ের সাথে আর যোগাযোগ করতে পারিনি।“

ইমরান বলেন, ‘আসফানের সাথে যারা কাজ করতেন তারা জানুয়ারিতে ফোন করে জানান, যে তার পায়ে গুলি লেগেছে।’

আসফান ছাড়াও রাশিয়ায় যাওয়া পাঞ্জাব-হরিয়ানার কিছু যুবক তাদের আত্মীয়দের কাছে একটি ভিডিও পাঠিয়ে সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন।

ওই যুবকরা জানান, ভিসা ছাড়াই বেলারুশে ঢোকার পরে তাদের ভুল বুঝিয়ে রুশ সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।

ফটো অ্যাজেন্সি গেটি জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আসফানের পরিবার তার একটি ছবি দিয়ে সাহায্যের জন্য আবেদন করে। পরিবারটির অনুরোধ ছিল যাতে আসফানকে সময় মতো রাশিয়া থেকে সরিয়ে আনা যায়।

টাকার খেলা
হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, মুহাম্মদ ইমরান জানিয়েছিলেন যে অ্যাজেন্টদের মধ্যে একজনের দুবাইতে একটি অফিস ছিল এবং তারা চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রত্যেক যুবকের কাছ থেকে তিন লক্ষ ভারতীয় রুপি নিয়েছিল।

ফিনান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন আর ইমরান যে ‘বাবা ভ্লগস’ ইউটিউব চ্যানেলের কথা বলছিলেন, দু’টিই দেখেছে বিবিসি।

ওই চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবার প্রায় তিন লাখ। রাশিয়া নিয়ে যে ভিডিওটির কথা বলা হচ্ছে এখানে, সেটি গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর আপলোড করা হয়েছিল।

ওই চ্যানেলে অন্যান্য আরো অনেক দেশের ব্যাপারে তথ্য দেয়া হয়েছে আর বলা হয়েছে যে ওই সব দেশে চাকরির সুযোগ আছে।

মুহাম্মদ আসফানের মৃত্যুর খবর আসার পর থেকে ওই চ্যানেলে আর কোনো ভিডিও আপলোড করা হয়নি। এ বছরের জানুয়ারি মাসে সেখানে শেষ ভিডিওটি আপলোড করা হয়েছে।

হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুহাম্মদ ইমরান বলেছেন, রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর তার ভাই অ্যাজেন্টদের সাথে যোগাযোগ করে জানিয়েছিলেন যে তাকে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

অ্যাজেন্টরা আসফানকে জানায়, এটা কাজের অংশ। তারপরেই ওই তরুণদের নিয়ে যাওয়া হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে।

হিন্দুস্তান টাইমস মুহাম্মদ ইমরানকে উদ্ধৃত করে আরো লিখেছে যে, অ্যাজেন্টরা দাবি করছে যে আসফান বেঁচে আছেন তবে দূতাবাস থেকে বলা হয়েছে যে তিনি মারা গেছেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ২ বছর
দুই বছর ধরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে।

সৈন্যের ঘাটতির কারণে রুশ সেনাবাহিনী হিমশিম খাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এমন খবরও এসেছে যে রুশ সেনাদের সাথে ভারতীয় নাগরিকদেরও যুদ্ধে নামানো হয়েছে।

রাশিয়ায় আটকে পড়া মানুষদের কথায়, অ্যাজেন্টরা তাদের বলেছিল যে সে দেশে নিয়ে গিয়ে সহায়ক আর নিরাপত্তারক্ষীর কাজ দেয়া হবে।

তবে সেখানে গিয়ে যে সেনাবাহিনীতে কাজ করতে হবে, সেটা তারা জানায়নি।

অ্যাজেন্টদের ওই নেটওয়ার্কের দু’জন রাশিয়ায় এবং দু’জন ভারতে থাকে বলে জানা যাচ্ছে।

ফয়সাল খান নামে আরেক অ্যাজেন্ট দুবাইয়ে থাকতেন, যিনি ওই চারজন অ্যাজেন্টের মধ্যে সমন্বয় করতেন।

ফয়সাল খানই ‘বাবা ভ্লগস’ নামের ওই ইউটিউব চ্যানেলটি চালাতেন।

ওই অ্যাজেন্টরা মোট ৩৫ জনকে রাশিয়ায় পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল। প্রথম দফায় ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর চেন্নাই থেকে তিনজনকে শারজাহ পাঠানো হয়।

সেখান থেকে ১২ নভেম্বর তাদের রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে নিয়ে যাওয়া হয়।

ফয়সাল খানের দল ১৬ নভেম্বর প্রথমে ছয়জন এবং পরে সাতজন ভারতীয়কে রাশিয়ায় নিয়ে যায়।

‘বাবা ভ্লগস’-র সাফাই
ওই ভারতীয়দের পরিবারগুলো বলছে যে তাদের বাড়ির ছেলেদের কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তারপর গত বছর ২৪ ডিসেম্বর তাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ানো হয়।

‘বাবা ভ্লগস’- এর ফয়সাল খান বিবিসির সাথে কথা বলেছেন।

তিনি জানিয়েছেন, ‘চাকরি প্রার্থীদের জানিয়েছিলাম যে সেনাবাহিনীতে সহায়কের চাকরি দেয়া হবে। আমার ইউটিউব চ্যানেলে আগে পোস্ট করা ভিডিওগুলো দেখতে পারেন।’

‘আমরা রাশিয়ার কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছিলাম যে এই ব্যক্তিরা সেনাবাহিনীতে সহায়কের চাকরির জন্য আবেদন করেছেন। আমি প্রায় সাত বছর ধরে এই কাজ করছি। এ পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় প্রায় দুই হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি।’

চাকরির জন্য রাশিয়ায় যাওয়া কয়েকজনের নাম খুঁজে পেয়েছে বিবিসি।

তারা হলেন হায়দরাবাদের মুহাম্মদ আসফান, তেলেঙ্গানার নারায়ণপেটের সুফিয়ান, উত্তর প্রদেশের আরবান আহমেদ, কাশ্মীরের জহুর আহমেদ, গুজরাটের হামিল এবং কর্ণাটকের গুলবার্গের সৈয়দ হুসেন, সামির আহমেদ ও আব্দুল নাইম।

সূত্র : বিবিসি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877