স্বদেশ ডেস্ক:
আগামী মাসে তথা মার্চের প্রথম দিন থেকে ফের বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে৷ একইসাথে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের কথাও বলেছেন খনিজ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ৷
এখন পর্যন্ত যা আভাস পাওয়া গেছে তাতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি ৩০ থেকে ৮০ পয়সা বাড়তে পারে৷ ২০২৩ সালের মার্চে সর্বশেষ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়৷ তখন বাড়ানো হয় শতকরা পাঁচ ভাগ৷
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, এবার তিন থেকে চার শতাংশ বাড়বে৷ তবে বিদ্যুতের দামের নানা ধরনের স্লট থাকায় লাইফ লাইন পর্যায়ে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না বলে তিনি দাবি করেছেন৷ তার কথা, ‘ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছে৷’
গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার এবং গ্রাহক পর্যায়ে ১৩ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে৷
এদিকে শীত যাওয়ার আগেই লোডশেডিং শুরু হয়ে গেছে৷ তবে পিডিবি দাবি করছে, এখন পর্যন্ত কোনো লোডশোডিং নেই৷ পিডিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শামীম আহসান বলেন, বৃহস্পতিবার বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১০ হাজার ৫৯৮ মেগাওয়াট, উৎপাদনও ছিল ঠিক সমপরিমাণ৷ কোনো ঘাটতি ছিল না৷ কিন্তু বাস্তবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং হয়েছে৷
এবার গ্রীষ্ম মৌসুমে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট৷ গত বছরের চেয়ে চাহিদা বেড়েছে ১১ শতাংশের মতো৷ মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৪৮১ মেগাওয়াট হলেও এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট হয়েছে গত বছরের ১৯ এপ্রিল৷ এ বছর গরমের সময় সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও কোনোভাবেই লোডশেডিং এড়ানো যাবে না৷
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী শামসুল আলম বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেই বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় না৷ কারণ, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিনির্ভর৷ মূল কাঁচামাল হলো গ্যাস৷ এখন আমাদের গ্যাসেরই সংকট চলছে৷ উৎপাদন বাড়লে ব্যয় বাড়বে৷ আর সেটা আবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে নেয়া ছাড়া সরকার আর কোনো পথ দেখছে না৷ ফলে লোডশেডিং করেই সরকার খরচ কমাবে৷’
তার কথা, ‘বারবার একতরফাভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে৷ কোনো গণশুনানি করা হচ্ছে না৷ কিন্তু ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটিয়ে, দুর্নীতি কমিয়ে, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে বসিয়ে অর্থ দেয়া বন্ধ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমানো সম্ভব৷ সরকার সেটা তো করছে না৷ সাধারণ মানুষের ওপর দামের বোঝা চাপিয়ে কষ্ট দিচ্ছে৷’
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে গ্যাস লাগে, সেটা আমাদের আছে৷ কিন্তু গ্যাস উত্তোলন না করে একটি মহলকে সু্বিবধা দিতে আমদানি বাড়ানো হচ্ছে৷ ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়ছে৷’
বিদ্যুতের দাম বাড়লে তার পুরো চাপ সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে বলে মন্তব্য করেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ সভাপতি এস এম নাজের হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি আবার বাড়বে৷ বিদ্যুৎ খরচ বাড়ার প্রভাব পড়ে সবখানে৷ কৃষি ও ভোগ্যপণ্য, পরিবহণ খরচ সবকিছু বেড়ে যায়৷ কিন্তু সরকার চাইলে বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়েও পারে৷ ক্যাপাসিটি ট্যাক্সের নামে যে অর্থ পরিশোধ করা হয়, সেটা বাদ দিলে উৎপাদন খরচ কমে যায়৷ আর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও এখানে কমছে না৷ এই জ্বালানি তেলের ব্যবসা আবার সরকার এবকভাবে করে৷’
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘আবারো বিদ্যুতের দাম বাড়লে পোশাক শিল্পসহ সব শিল্পেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ এর আগে শিল্প গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে৷ কিন্তু আমরা গ্যাস পাই না৷ আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়েছে৷ বিদ্যুতের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচ আরো বাড়বে৷ এমনিতেই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিসহ নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ ভাগ এবং ইউরোপে ১৭ ভাগ পোশাক রফতানি কমে গেছে৷’
তবে বিষয়টিকে পুরো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিপর্যয় হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর৷ তিনি বলেন, ‘ভ্রান্ত নীতির কারণে আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে৷ যেখানে আমাদের জ্বালানি সার্বভৌমত্ব থাকার কথা ছিল, সেখানে আমরা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছি৷ ফলে আমরা এখন অন্যের ওপর নির্ভশীল৷ তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ-এর একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কিত৷ এর মধ্যে আমাদের গ্যাস থাকলেও তা উত্তোলন না করে আমরা এলএনজি আমদানি করছি৷ ফলে বিদ্যুতে আমরা বিপর্যয়ের মুখে পড়ছি৷ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে৷ আর সেই খরচ নেয়া হচ্ছে গ্রাহকদের কাছ থেকে৷ সরকারের ভ্রান্ত নীতির বলি হচ্ছেন গ্রাহকরা৷’
তার কথা, ‘বিদ্যুতের দাম বাড়লে কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের খরচ বেড়ে যায়, বেড়ে যায় পরিবহণ খরচ৷ ফলে সার্বিকভাবে সব কিছুর দাম বেড়ে যায়৷ বেড়ে যায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি৷ যার চাপ পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর৷’
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আয় না বাড়লে যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, সীমিত আয়ের মানুষ, তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়৷ তারা কম কেনেন, কম খান৷ ফলে পুষ্টির অভাব দেখা দেয় আর দারিদ্র্য বেড়ে যায়৷ যেমন ঢাকা শহরে দারিদ্র্য বেড়েছে৷’
সূত্র : ডয়চে ভেলে