জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে চার দফা প্রস্তাব তুলে ধরবেন। জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের একটি অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। রোহিঙ্গা সঙ্কটকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এর সমাধান মিয়ানমারের ভেতরেই খুঁজে পেতে হবে। জোরপূর্বক নির্বাসিত, মিয়ানমারের ১১ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। মানবিক দিক বিবেচনা করে আমরা দেশের সীমান্ত খুলে দিয়েছিলাম তাদের জন্য। আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের মৌলিক সব প্রয়োজন মেটাতে এবং তাদের দেশে ফেরত না যাওয়া পর্যন্ত সম্ভব সব ধরনের পদক্ষেপ অব্যাহত রাখবে বাংলাদেশ। একই অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের এখনই সমাধান হওয়া উচিত। আজ শুক্রবার সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী যে চারটি প্রস্তাব তুলে ধরবেন, সেগুলো হচ্ছেÑ রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তন বিষয়ে মিয়ানমারকে অবশ্যই রাজনৈতিক ইচ্ছা সুস্পষ্ট করতে হবে। ফেরত নিতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কী করছে, সেটিও বলতে হবে। বৈষম্যমূলক আইন ও চর্চা পরিত্যাগ করতে হবে এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের উত্তর রাখাইন রাজ্যে ‘যাও এবং দেখো’ এ নীতিতে পরিদর্শনের অনুমতি দিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হবে। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনেও প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সেই প্রস্তাবে কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়নসহ রাখাইন রাজ্যে একটি বেসামরিক নিরাপদ পর্যবেক্ষণ এলাকা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও ছিল।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এসব প্রস্তাব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে যাতে সাড়া দেয়, সে জন্য যথাযথ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। বিশ্বনেতাদের বোঝাতে হবে, এ সঙ্কট এখন আর মিয়ানমার বা বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; এটি পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে। তাই বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। রাখাইনে গণহত্যার মাধ্যমে মানবতার চরম লঙ্ঘন করা হয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বেসামরিক পর্যবেক্ষক মোতায়েন করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই রোহিঙ্গাসহ সবার নিরাপত্তা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমারের পরিস্থিতি মোটেও আশাপ্রদ নয়। রাখাইনে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গারা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তচ্যুত। তাদের স্থান হয়েছে এমন এক শিবিরে, যাতে এক প্রকার বন্দি জীবন কাটাতে হয়; অথচ মিয়ানমার সেখানে জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধি ও মানবাধিকার কর্মীদের ঢুকতে দেয়নি। যদি মিয়ানমারের লুকানোর কিছু না থাকে, তবে সেখানকার পরিস্থিতি দেখাতে এত অনীহা কেন? তারাই সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারই দায়ী। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মিয়ানমারে ফিরতে রাজি না হওয়াই স্বাভাবিক। কেউ যদি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বোধ না করে, তবে সে ফিরবে কেন? এ জন্য তাদের নিরাপদ, সম্মানজনক ও স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কর্তব্য জোরালো চাপ অব্যাহত রাখা। এ সঙ্কট সমাধানে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব জরুরি।
সব দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার পাশে থাকার বিকল্প নেই বিশ্বনেতাদের। ‘বাংলাদেশের পক্ষে থাকা’র অর্থ হলো, মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। শুধু আশ্বাসই যথেষ্ট নয়, ফলপ্রসূ কিছু করে দেখাতে হবে। এ সমস্যার টেকসই সমাধান বের করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নেপিডোর গণহত্যার সাথে যারা জড়িত, তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর পদক্ষেপ নেয়াও অতীব জরুরি। এটি এ জন্য প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো দেশ সংখ্যালঘুদের ওপর হীনস্বার্থে নির্যাতন চালাতে সাহস না করে।