স্বদেশ ডেস্ক:
দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অবস্থিত বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে কয়লা গায়েবের ঘটনাকে সরকার গঠিত সব তদন্ত কমিটি ‘সিস্টেম লস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ঘটনার নানা বিশ্লেষণ করে তারা বলেছে, বড়পুকুরিয়ার কয়লা মূলত চুরি হয়নি।
উৎপাদনকাল থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত হিসাব করে ‘সিস্টেম লস’ ধরলে উল্লিখিত পরিমাণ কয়লা থাকার কথা নয়। আগে উত্তোলন ও সরবরাহের হিসাব নিয়মিত এবং সঠিক পদ্ধতিতে না করার কারণে হঠাৎ করে অনেক বেশি কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি নজরে পড়ে। যদিও এ ঘটনা দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তদন্ত করেছে।
সেখানে তেমন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। দুদক তাদের নিজস্ব তদন্তে কয়লা উধাওয়ের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে; যে মামলাটি এখন বিচারাধীন।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে গত বছরের জুলাইয়ে হঠাৎ করে ১ লাখ ৪৭ হাজার টন কয়লা উধাও হয়ে যায়। এর ফলে কয়লা সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যায় উত্তরাঞ্চলের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে। যার কারণে সরকারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। সাজার আওতায় আনা হয় খনির চার কর্মকর্তাকে।
পরে সরকারের নীতিনির্ধারকদের নির্দেশে বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু দীর্ঘসময় পর তদন্ত কমিটিগুলো জ্বালানি বিভাগে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে এ ঘটনায় অভিযুক্তদের ভাষ্যই অনেকটা উঠে এসেছে। ঘটনাটি জানাজানির আগ পর্যন্ত খনির দায়িত্বে থাকা বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবউদ্দিন আহম্মদ দাবি করেছিলেন, কয়লা উধাও হয়নি, বরং সিস্টেম লসের সঠিক হিসাব না হওয়ায় গায়েব মনে হচ্ছে। আমাদের এখানে যেটুকু কয়লা উবে গেছে, তার পরিমাণ ১ দশমিক ৪ শতাংশের বেশি হবে না। আন্তর্জাতিকভাবে ২ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য। তদন্তে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ওই জুলাই মাসেই তাকে বড়পুকুরিয়া থেকে সরিয়ে পেট্রোবাংলায় যুক্ত করা হয়।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, কয়লা উধাওয়ের ঘটনায় সংস্থাটির পরিচালককে (অপারেশন অ্যান্ড মাইন্স) আহ্বায়ক করে গত বছরের ১৯ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি কয়লার ঘাটতিকে ‘সিস্টেম লস’ বা কারিগরি লোকসান হিসেবে উল্লেখ করে আরও অধিকতর তদন্তের পরামর্শ দেয়। ওই বছরেরই ২৯ জুলাই পেট্রোবাংলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে একাধিক মাইনিং বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত থেকে তদের মতামত দেন। এ ছাড়া গত বছরের ৩০ আগস্ট জ্বালানি বিভাগের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার বিশদ তদন্তের জন্য মাইনিং বিষয়ে অভিজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক, ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের এক পরিচালক, কোল মাইনিং বিষয়ে অভিজ্ঞ পেট্রোবাংলার দুই কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিও গত বছরের ২০ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। সেখানে বলা হয়েছে, উৎপাদন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবহন ও মজুদকালে রোদের তাপ, খোলা বাতাস ও বৃষ্টির পানিতে কয়লার ওজন হ্রাস খুবই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে ১ দশমিক ৪২ শতাংশ সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিস্টিম লস ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এ ছাড়াও ওই বছরের ২৯ নভেম্বর তৎকালীন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান যিনি একই সঙ্গে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনি জ্বালানি সচিবকে চিঠি লিখে কারিগরি কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত মতামত ব্যাখ্যা করেন। সেখানে তিনি জানান, কয়লা উত্তোলন ও বিপণন ব্যবস্থায় সিস্টেম লস রয়েছে। কোল ইয়ার্ড থেকে কয়লা সরবরাহের ক্ষেত্রে সিস্টেম লসের পরিমাণ বেশি। সেখানে স্পন্টেনিয়াস কম্ভাস্টন বা আগুন জ্বলা, বৃষ্টির পানিতে কয়লা ধুয়ে যাওয়া, ঝড়বৃষ্টি বা বাতাসে কয়লা ক্ষয় হওয়া, ইয়ার্ডে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া, পরিবহনে সময় নষ্ট হওয়ার কারণে সিস্টেম লস হয়েছে।
এ লসের পরিমাণ বা হার মূলত স্টক ইয়ার্ডে কয়লা মজুদের স্থায়িত্বকাল, স্তূপের উচ্চতা, আবহাওয়ার তারতম্যের ওপর নির্ভর করে। যার পরিমাণ ১ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান তার চিঠিতে ভবিষ্যতে কয়লার মজুদের হিসাব সমন্বয়ের জন্য নির্দেশনা প্রদানের বিবেচনা করতে বলেন।
ওই ঘটনায় গঠিত টেকনিক্যাল কমিটিগুলোও তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, কয়লার ফিজিবিলিটি স্টাডি করে ব্রিটিশ কোম্পানি মেসার্স ওর্য়াডলে আর্মস্টং নামক প্রতিষ্ঠান বলেছে, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে আর্দ্রতার পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ। দীর্ঘদিন ইয়ার্ডে পড়ে থাকার কারণে কয়লার আর্দ্রতা কমে এর ওজন কমে যায়। আবার খনি থেকে উত্তোলনকালে কয়লার সঙ্গে আসা মাটি-পাথর বিক্রির সময় আলাদা করা বা সরিয়ে ফেলার কারণেও উৎপাদন পয়েন্ট থেকে যে পরিমাপে কয়লা ইয়ার্ডে যায়, পরে একই পরিমাণ থাকে না।
কয়লা উধাওয়ের ঘটনাটি যদি পুরোটাই সিস্টেম লস হবে, তা হলে কেন দুদক এ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেÑ এমন প্রশ্নে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা বলেন, সেটা দুদকের বিষয়। তারা নিশ্চয় তাদের মতো তদন্ত করে কোনো ত্রুটি পেয়েছে। তবে আমি বলব সিস্টেম লস হওয়াটা স্বাভাবিক। কয়লা উত্তোলন থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত কোনো সিস্টেম লস হবে না সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আবার একেবারে চুরি হয়নি, সেটাও বলব না। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু এদিক-সেদিক হলেও বিশাল পরিমাণ কয়লা উধাও হয়ে যেতে পারে না। দীর্ঘসময় সঠিক পদ্ধতিতে হিসাব না করায় এটা হতে পারে।
এদিকে বড়পুকুরিয়া খনির ২০১৭-১৮ সালের বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রস্তুতকৃত বইতেও দেখা যায়, উধাও হওয়া ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ টন কয়লাকে সিস্টেম লস হিসাবে দেখিয়েছে কর্তৃপক্ষ।