স্বদেশ ডেস্ক:
ইসলাম হলো শাশ্বত সুন্দর ও পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। মানবতার মুক্তির গ্যারান্টি। সর্বত্র স্বস্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অনন্য মাধ্যম। সেই সুমহান আদর্শের একটি বিশেষ নিদর্শন হচ্ছে পারস্পরিক সালাম বিনিময়। সালামের মতো অর্থবহ, আকর্ষণীয় ও প্রশান্তিময় সম্বোধন আর কিছু হতে পারে না। মুসলিম হিসেবে আমরা এর পক্ষাবলম্বন করছি কিংবা শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে যাচ্ছি; ব্যাপারটি এ রকম নয়। নিরপেক্ষ গবেষণা ও পর্যালোচনা করলেও এই তথ্য সুনিশ্চিত হবে, সন্দেহ থাকবে না।
রাসূলুল্লাহ সা: সালামের ব্যাপক প্রচলন প্রত্যাশা করতেন। নিজেও সেই আমল করেছেন। এমনকি ছোট্ট শিশুদের পর্যন্ত তিনি সালাম দিতেন। হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি কিছুসংখ্যক শিশুর কাছ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাদের সালাম দিলেন এবং বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: এরূপ করতেন’ (বুখারি-৬২৪৭, মুসলিম-২১৬৮)।
আল্লাহ তায়ালা সালামের ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা আয়াতে কারিমার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। যেমন- সূরা নূরের ৬১ নং আয়াতে জানিয়ে দিয়েছেন- ‘যখন তোমরা ঘরে প্রবেশ করবে, তখন তোমরা তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এ হবে আল্লাহর কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র অভিবাদন।’ এই আয়াতে নিজ ঘরে প্রবেশের কিছু আদব-কায়দা বর্ণনা করা হয়েছে। আর তা হলো এই যে, প্রবেশের সময় বাড়ির লোকদের সালাম দাও। মানুষ নিজের স্ত্রী-সন্তানদের ওপর সালাম করা বোঝা বা অপ্রয়োজনীয় মনে করে। কিন্তু ঈমানদার ব্যক্তির জন্য জরুরি আল্লাহর আদেশ পালন করে সালাম দেয়া। নিজের স্ত্রী-সন্তানদের শান্তির দোয়া দেয়া থেকে কেন বঞ্চিত রাখা হবে?
একইভাবে অন্য লোকদের বাসাবাড়িতে প্রবেশের সময় অনুমতি নেয়া ও সালাম দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা একই সূরার ২৭ নং আয়াতে জানিয়ে দিয়েছেন- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের ঘর ব্যতীত অন্য কারো ঘরে গৃহবাসীদের অনুমতি না নিয়ে ও তাদেরকে সালাম না দিয়ে প্রবেশ করো না।’ তাফসিরে আহসানুল বায়ানের বর্ণনায় পাওয়া যায়, আলোচ্য আয়াতে গৃহে প্রবেশের অনুমতি নেয়ার কথা আগে এবং সালাম দেয়ার কথা পরে উল্লেখ হয়েছে। কিন্তু হাদিস থেকে জানা যায়, নবী সা: প্রথমে সালাম দিতেন এবং পরে প্রবেশ করার অনুমতি নিতেন। অনুরূপ মহানবী সা:-এর এও অভ্যাস ছিল, তিনি তিন তিন বার অনুমতি চাইতেন। অতঃপর কোনো উত্তর না পেলে তিনি ফিরে যেতেন। নবী সা:-এর বরকতময় এ অভ্যাসও ছিল যে, অনুমতি চাওয়ার সময় দরজার ডানে অথবা বামে দাঁড়াতেন এবং একেবারে সামনে দাঁড়াতেন না যাতে (দরজা খোলা থাকলে অথবা খোলা হলে) সরাসরি ভেতরে নজর না পড়ে (বুখারি : ইসতিযান অধ্যায়, আহমদ ৩/১৩৮, আবু দাউদ : আদব অধ্যায়)। অনুরূপ তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি মারতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এমনকি বাড়ির ভেতরে যে উঁকি মারে সে ব্যক্তির চোখ বাড়ির লোক নষ্ট করে দিলেও তার কোনো অপরাধ নেই (বুখারি : দিয়াত অধ্যায়, মুসলিম : কিতাবুল আদাব)। মহানবী সা:-এর এটিও অপছন্দ ছিল যে, ভেতর থেকে বাড়ির মালিক ‘কে তুমি?’ জিজ্ঞাসা করলে, তার উত্তরে নাম না বলে কেবল ‘আমি’ বলা। অর্থাৎ, ‘কে’ জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে নিজের নামসহ পরিচয় দিতে হবে (বুখারি : ইসতেযান অধ্যায়, মুসলিম : আদাব অধ্যায়)।
সালামের ব্যাপক প্রচলন ঈমানি দায়িত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টির অন্যতম সহায়ক পদ্ধতি। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা: থেকে বর্ণিত- এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞেস করল, ‘সর্বোত্তম ইসলামী কাজ কী?’ তিনি বললেন, ‘(ক্ষুধার্তকে) অন্নদান করবে এবং পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সবাইকে (ব্যাপকভাবে) সালাম পেশ করবে’ (বুখারি-১২, ২৮, ৬২৩৬, মুসলিম-৩৯)। হজরত আবু উমারা বারা ইবনে আজিব রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের সাতটি (কাজের ব্যাপারে) আদেশ করেছেন- ১. রোগী দেখতে যাওয়া; ২. জানাজার অনুসরণ করা; ৩. হাঁচির জবাব দেয়া; ৪. দুর্বলকে সাহায্য করা; ৫. নির্যাতিত ব্যক্তির সাহায্য করা; ৬. সালাম প্রচার করা, এবং ৭. শপথকারীর শপথ পূরণ করা’ (বুখারি-১২৩৯, ২৪৪৫, ৫১৭৫, ৫৬৩৫, ৫৬৬০, ৫৮৩৮, ৫৮৪৯, ৫৮৬৩, ৬২২২, ৬২৩৫, ৬৬৫৪, মুসলিম-২০৬৬)।
হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর যতক্ষণ না তোমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা গড়ে উঠবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদের এমন একটি কাজ বলে দেবো না, যা করলে তোমরা একে অপরকে ভালোবাসতে লাগবে? (তা হচ্ছে) তোমরা আপসের মধ্যে সালাম প্রচার করো’ (মুসলিম-৫৪, তিরমিজি-২৬৮৮, আবু দাউদ-৫১৯৩)।
পারস্পরিক পরিচিতি, সম্পর্ক ও সম্প্রীতি বাড়ানোর জন্য সালামের ব্যাপক প্রচলন অনস্বীকার্য। মুমিন হৃদয়ে ঠাঁই পেতে সালাম কার্যকরী একটি আমল, যা দূরের মানুষকে কাছে নিয়ে আসে। সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি হলে, তা কমিয়ে দেয়। ভ্রাতৃত্ববোধকে অন্তরে সদা জাগরূক রাখে।
লেখক : সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরিন