সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৬:৩৭ অপরাহ্ন

আমাদের গৌরবময় ইতিহাস

আমাদের গৌরবময় ইতিহাস

হামিদ মীর:

২০২২ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহ। আমি অক্সফোর্ড ইউনিয়নের আমন্ত্রণে ব্রিটেনের প্রসিদ্ধ শহর অক্সফোর্ডে পৌঁছি। অক্সফোর্ড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমাকে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই বিতর্ক অনুষ্ঠানের এক দিন আগে আমাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাভাটনিক স্কুল অব গভর্নমেন্টে বক্তৃতা করতে হয়েছিল। সাউথ এশিয়া সোসাইটির তত্ত্বাবধানে ওই অনুষ্ঠানে আমার বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘দক্ষিণ এশিয়ায় মিডিয়ার স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন’। বক্তৃতা শেষ হলে বহু ভারতি, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী আমাকে ঘিরে ধরে। তাদের বেশির ভাগই পাবলিক পলিসি নিয়ে পড়ছেন। তারা দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় উগ্রতাসহ রাজনৈতিক বিদ্বেষের বাড়াবাড়ি নিয়েও চিন্তিত।

ওই বক্তৃতা অনুষ্ঠানে নতুন দিল্লির এক হিন্দু ছাত্রী ও শ্রীনগরের এক মুসলমান ছাত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই দু’জন যখন অক্সফোর্ডে আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখন ভারতে মুসলমানদের পক্ষ থেকে বিজেপির দুই নেতার নবী মোহাম্মদ সা:-এর প্রতি ধৃষ্টতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। পরের দিন অক্সফোর্ড ইউনিয়নে বিতর্ক অনুষ্ঠান ছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘ব্রিটিশ রাজ এখনো শেষ হয়নি।’ আমি শিরোনামের পক্ষে বক্তৃতা করি। আমি বলি, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে আজো এমন অনেক ঔপনিবেশিক আইন বিদ্যমান আছে, যা আমাদের ব্রিটিশ রাজের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভারতের তামিলনাড়- রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ড. থিয়াগা রাজন আমার অবস্থানকে খণ্ডন করেন। কিন্তু যখন অক্সফোর্ড ইউনিয়নের প্রথামাফিক হলে উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের মতামত নেয়া হলো, তখন বেশির ভাগই আমার অবস্থানকে সঠিক বলে অভিহিত করেন। বিতর্ক অনুষ্ঠান শেষ হলো। আমি অক্সফোর্ড ইউনিয়নের ঐতিহাসিক হল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতেই ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে ঘিরে ধরে। কেউ সেলফি তুলল, কেউ প্রশংসা করল।

এক ছাত্রী বেশ বিশুদ্ধ ইংরেজিতে আমাকে বলল, স্যার, এখানে অক্সফোর্ডে আমরা না ভারতি, না পাকিস্তানি, না হিন্দু, না মুসলমান। আমাদের পরিচয় শুধুই শিক্ষার্থী। কিন্তু আমরা যখন আমাদের মাতৃভ‚মিতে ফিরে যাবো, তখন নিজেদের ভুল ইতিহাসের কয়েদি হয়ে যাবো এবং একে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের অগ্নিবর্ষণ করব। ওই ছাত্রী আমাকে বলল, ভারত ও পাকিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের ভুল ও অসম্পূর্ণ ইতিহাস পড়ানো হয়। এ ভুল ইতিহাস আমাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করে। আপনি এই ভুল ইতিহাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন। সেখানে উপস্থিত সব ভারতীয় ও পাকিস্তানি ছাত্র-ছাত্রী তাদের সঙ্গীর অবস্থানকে সমর্থন করে। এটি আমার জন্য এক মনোরম বিস্ময় ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার নতুন জেনারেশন বানোয়াট সংবাদ থেকে এগিয়ে গিয়ে বানোয়াট ইতিহাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিল।

এ লেখাটি বানোয়াট ইতিহাসের বিপক্ষে ভুল নিরসনের একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস। ভারত ও পাকিস্তানে কয়েকজন ইতিহাসবিদ ইতিহাসের সম্ভ্রমহানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু তাদের আওয়াজ মিডিয়াতে খুব কমই শোনা যায়। দুঃখ হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় যারা একে অপরের সাথে ধর্ম, গোত্র, ভাষা ও রাজনীতির ভিত্তিতে বিদ্বেষ পোষণ করে, তাদের কয়েক হাজার বা কয়েক শত বছরের পুরনো ইতিহাস তো দূরের কথা, মাত্র কয়েক বছরের পুরনো ইতিহাস সম্পর্কেও জানাশোনা নেই। আসুন সর্বপ্রথম এটি জানার চেষ্টা করি যে, উপমহাদেশে ইসলাম কিভাবে এসেছে। এ প্রশ্ন এ জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ যে, একটা দীর্ঘ সময় ধরে ভারতে হিন্দু উগ্রপন্থীরা এটা দাবি করছে যে, উপমহাদেশে ইসলাম তরবারির জোরে প্রসার লাভ করেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা শিহাবুদ্দীন ঘুরী, মাহমুদ গজনবী ও মোগল বাদশাহদের ইসলাম প্রসারের জন্য দায়ী করে যাচ্ছে। অপর দিকে, পাকিস্তানে এমন কিছু গ্রন্থ রয়েছে, যেখানে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ইসলাম প্রচার-প্রসারের কৃতিত্ব দেয়া হয়। ঐতিহাসিক সত্য একেবারে ভিন্ন। উপমহাদেশে ইসলাম না এনেছেন ঘুরী কিংবা গজনবী। না এনেছেন মুহাম্মদ বিন কাসিম কিংবা অন্য কোনো বিজেতা। উপমহাদেশে ইসলাম বণিকদের মাধ্যমে ছড়িয়েছে।

এ বণিকরা সমুদ্রপথে আরব দেশগুলোতে যাতায়াত করতেন। উপমহাদেশে প্রথম মসজিদ মুহাম্মদ সা:-এর জীবদ্দশাতেই কেরালাতে নির্মিত হয়। ভারতের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর রোমিলা থাপর তার The Past as Present গ্রন্থে সুদৃঢ় ঐতিহাসিক প্রমাণাদির মাধ্যমে এটা প্রমাণ করেন যে, উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানের বিদ্বেষের মূল কারণ সেসব ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ, যারা বিশেষ ঔপনিবেশিক অ্যাজেন্ডা হিসেবে ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন এবং দু’টি ধর্মকে একে অপরের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ‘দাঙ্গা বাধাও এবং শাসন করো’র নীতিতে কাজ করেছেন। রোমিলা থাপর ব্রিটিশ লেখক জেমস মিলের The History Of British India গ্রন্থে বর্ণিত ‘ইসলাম বহিরাগত আক্রমণকারীদের সাথে এসেছে’ তথ্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

রোমিলা থাপর লিখেছেন, মাহমুদ গজনবী সোমনাথের এক মন্দিরে ১০২৬ সালে আক্রমণ করেন। ওই এলাকায় ইসলাম আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। যে হিন্দুরাজা মাহমুদ গজনবীর মোকাবেলা করেন, তার বাহিনীতে মুসলমানও ছিল। রোমিলা থাপর লিখেছেন, সোমনাথে মাহমুদের আক্রমণের ২০০ বছর পর ১২৬৪ সালে ইরানের বণিক নুরুদ্দিন ফিরোজ সোমনাথে একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য স্থানীয় রাজা শ্রী চাড়ার কাছ থেকে জমি ক্রয় করেন। জমির কাগজপত্র সংস্কৃত ও আরবি ভাষায় প্রস্তুত করা হয়। রোমিলা থাপর ওই কাগজপত্রের অনুবাদ তার গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন। সব নির্ভরযোগ্য ভারতীয় ইতিহাসবিদ একমত যে, কেরালা ও ভারতীয় গুজরাটে ইসলাম তরবারি নয়, বাণিজ্যের মাধ্যমে ছড়িয়েছে। মুসলমান বণিকরা এখানে বিয়েশাদি করেন এবং এখানেই থিতু হন। পক্ষান্তরে ঘুরী ও গজনবী অনেক পরে এসেছেন।

মুহাম্মদ ইসহাক ভাট্টির ‘বাররে সাগীর মেঁ ইসলাম কে আওয়ালিন নুকুশ’ গ্রন্থে এ কথা বলা হয়েছে যে, মোহাম্মদ সা:-এর জীবদ্দশায় আরব বণিকেরা উপমহাদেশে আসা-যাওয়া করতেন। বরং ভারতের জাট মদিনা মুনাওয়ারাতেও বিদ্যমান ছিল। ভাট্টি সাহেব হজরত আবু সাঈদ খুদরী রা: এর উদ্ধৃতিতে লিখেছেন, একবার জনৈক ভারতীয় রাজা নবীকে শুষ্ক আদা হাদিয়া পাঠান, যা রাসূলুল্লাহ সা: সাহাবায়ে কেরামের মাঝে বণ্টন করে দেন। নবীর ইন্তেকালের পর হজরত উমর ফারুকের খেলাফতের সময় হজরত হাকীম ইবনে আবুল আস এর বাহিনী মুম্বাইয়ের সন্নিকটে থানা নামক বন্দরে এসেছিল। উপমহাদেশ অঞ্চলে ২৫ জন সাহাবি আগমন করেন। ১২ জন হজরত উমর এর যুগে, পাঁচজন হজরত উসমান রা: এর যুগে, তিনজন হজরত আলী রা: এর যুগে এবং বাকিরা হজরত মুয়াবিয়া রা: এর শাসনকালে আগমন করেন। তাঁদের সবার পরে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুতে আসেন এবং ওই সময় তাঁর বয়স ছিল ২৮ বছর।

মুহাম্মদ ইসহাক ভাট্টি লিখেছেন, মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু আগমনের ৭৮ বছর আগে উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটে। এটা সেই বাস্তবতা, যা ভারত-পাকিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে সন্নিবেশিত নেই। ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, কিন্তু উভয় দেশই এখনো ব্রিটিশ লেখকদের লেখা মিথ্যা বানোয়াট ইতিহাস থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। যখন হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা মুম্বাই বা দিল্লিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরোপ করে যে, তোমরা তরবারির জোরে ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছ, তখন মুসলমানদের কাছে কোনো শক্ত জবাব থাকে না। কেননা তাদের নিজেদের আসল ইতিহাস সম্পর্কে জানাশোনা নেই যে, ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ বাহিনীর হিন্দু-মুসলমান সিপাহিরা ব্রিটিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পর ব্রিটিশ রাজ উভয়কে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামিয়ে দেয়।

১৮৬৭ সালে ইংরেজরা হিন্দুদের সাথে যোগসাজশ করে উপমহাদেশ থেকে ফার্সি ও উর্দু ভাষাকে বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টা করলে স্যার সৈয়দ আহমদ খান সেই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খান হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু ফার্সি ও উর্দুর বিলুপ্তিকে মুসলিম স্বকীয়তার ওপর হামলা মনে করতেন। তিনি মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষা অর্জন ও ইংরেজি শিখতে উদ্বুদ্ধ করতেন, যাতে মুসলমানরা তাদের অধিকার রক্ষা করতে পারে। সে সময়েই এমন আন্দোলন শুরু হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের আবার হিন্দু বানানো। তন্মধ্যে শুদ্ধি আন্দোলনও ছিল, যার উদ্দেশ্য উপমহাদেশের সব মুসলমান ও খ্রিষ্টানকে হিন্দু বানিয়ে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। রামরাজ্যের অপর নাম অখণ্ড ভারত। এতে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, বার্মা ও শ্রীলঙ্কাসহ আফগানিস্তানকেও শামিল করা হয়।

শুদ্ধি আন্দোলনের কারণে শিক্ষিত মুসলমানরা একটি পৃথক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। যেখানে তারা নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবেন। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ১৯০৬ সালে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জন্ম হয়। মুসলিম লীগ যখন গঠিত হয়, তখন আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজম হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস সেকুলারিজমের নামে মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছিল। সুতরাং আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজম নিজেদের অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবেন এবং পৃথক রাষ্ট্রের দাবি শুরু করেন। কিছু বুদ্ধিজীবী দাবি করেন, কায়েদে আজম ব্রিটিশ সরকারের কথায় পাকিস্তানের দাবি করেন। এ দাবি একেবারেই মিথ্যা ও প্রতারণা। পৃথক রাষ্ট্রের দাবি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শুরু হয়েছিল, যখন আবদুল জাব্বার খায়রী ও আবদুস সাত্তার খায়রী ইউপি, সিন্ধু, কর্নাটক, মহিশুর ও দিল্লিকে একটি পৃথক রাষ্ট্র বানানোর দাবি করেন।

১৯২৮ সালে মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহ. এটাই দাবি করেছিলেন। ১৯২৮ সালে সাংবাদিক গোলাম হাসান কাজেমী অ্যাবোটাবাদে সাপ্তাহিক পাকিস্তানের ডিক্লারেশনের জন্য আবেদন করেন। কয়েক বছর পর চৌধুরী রহমত আলি ‘পাকিস্তান’ নাম দিয়ে স্কিম পেশ করেন। সেখানে ‘আই’ অক্ষর ছিল না। ছিল Pakstan. পরবর্তীতে কায়েদে আজম সেখানে ‘আই’ অক্ষর যুক্ত করান। শিক্ষক ও গবেষক ড. আনিস আহমদের গবেষণা মোতাবেক চৌধুরী রহমত আলির স্কিমে ‘পি’ অক্ষর ছিল পাঞ্জাবের জন্য, ‘এ’ ছিল আফগানের জন্য, ‘কে’ কাশ্মির, ‘এস’ সিন্ধু ও ‘স্তান’ ছিল বেলুচিস্তানের জন্য। কায়েদে আজম সেখানে ‘আই’ অক্ষর যুক্ত করিয়ে সেটাকে Pakistan বানান। এখানে ‘আই’ অক্ষর ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করছে, যা অবশিষ্ট সব অঞ্চলকে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করেছিল। ড. আনিস আহমদের ধারণা মতে, পাকিস্তান গঠনের পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঔপনিবেশিক ইতিহাস পড়ানো হতে থাকে। এই ঔপনিবেশিক চিন্তাধারা আমাদের মাঝে জাতিগত ও ভাষাগত দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে।

সেনা স্বৈরশাসকেরা জাতীয় চিন্তাধারা পোষণকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে দুর্বল করে দেয়। যার ফলে পাকিস্তান ভেঙে যায়। সেসব পথভ্রষ্ট লোক, যারা কায়েদে আজমকে ইংরেজদের এজেন্ট বলে অভিহিত করে, তারা এ কথা ভুলে যায় যে, ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের লাহোর বৈঠকে যে প্রস্তাবাবলি গৃহীত হয়, তাতে একটি প্রস্তাব ফিলিস্তিনি মুসলমানদের পক্ষেও ছিল। ওই সময় ব্রিটিশ রাজ ফিলিস্তিনকে টুকরো করার ষড়যন্ত্র করছিল। ফিলিস্তিন মুসলমানদের প্রতিনিধি মুফতি আমীনুল হোসাইনির সাথে কায়েদে আজমের যোগাযোগ হতো। কায়েদে আজম শুধুই নিয়মিত ফিলিস্তিন দিবস পালন করতেন, তা নয়, বরং তিনি ফিলিস্তিন ফান্ডের নামে অর্থ সংগ্রহ করে মুফতি আমীনুল হোসাইনির কাছে পাঠাতেন। মুফতি আমীনুল হোসাইনিকে ব্রিটিশ রাজ সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করেছিল। কিন্তু কায়েদে আজম তাকে স্বাধীনতাকামী মনে করতেন।

আফসোস বর্তমান প্রজন্মের এ কথা জানা নেই যে, ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ কায়েদে আজম শুধুই একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপন করেননি, বরং তিনি ফিলিস্তিনকে টুকরো করে দেওয়ারও বিরোধিতা করেন। ব্রিটিশ রাজের এই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদকারী কায়েদে আজমকে ইংরেজদের এজেন্ট বলা চাঁদে থুথু নিক্ষেপের নামান্তর। একইভাবে ভারতে এমন লোকের সংখ্যা কম নয়, যারা পাকিস্তানের সাথে কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্পর্ক জুড়ে দেয়। অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরের মুসলমানদের অধিকাংশ বাস্তবেই পাকিস্তানকে ভালোবাসে, কিন্তু কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলন পাকিস্তান গঠনের অনেক আগে শুরু হয়েছিল। আজো সমগ্র জম্মু-কাশ্মিরে প্রতি বছর ১৩ জুলাই কাশ্মির শহীদ দিবস পালন করা হয়। এটা সেই দিন, যেদিন ১৯৩১ সালে শ্রীনগরে সেন্ট্রাল জেলে মালাকান্ডের পাখতুন আবদুল কাদেরের বিরুদ্ধে এক আপত্তিমূলক বক্তৃতার অপরাধে মামলা চলছিল। শ্রীনগরের মুসলমানরা তাদের এই পাখতুন ভাইয়ের পক্ষে মিছিল বের করে এবং জেলের প্রাচীরে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকে। ওই সময় তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। বহু মুসলমান শহীদ হন।

এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৯৩১ সালের ১৪ আগস্ট লাহোর গেটের বাইরের উদ্যানে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়, যার সভাপতিত্ব করেন আল্লামা ইকবাল। আর এখানেই প্রথমবারের মতো কাশ্মিরের স্বাধীনতার স্লোগান দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান কায়েম হয়, কিন্তু কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘোষক আল্লামা ইকবাল উভয় কাশ্মিরকে বেশ ভালোবাসতেন। কায়েদে আজম কয়েকবার গ্রীষ্ম মৌসুমের ছুটি কাটিয়েছেন কাশ্মিরে। তার প্রাইভেট সেক্রেটারি কে এইচ খুরশিদ ছিলেন শ্রীনগরের অধিবাসী। কাশ্মির ও ফিলিস্তিনের সাথে ইকবাল ও কায়েদে আজমের সম্পর্ককে জনগণের কাছে লুকানো হয়েছে। ইকবাল সুন্নি আকিদার ঘরানার মানুষ ছিলেন। কায়েদে আজম শিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তবে উভয়েই সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারামুক্ত সরল মুসলমান ছিলেন। উভয়ের বিরুদ্ধেই উগ্রপন্থীরা কুফরের ফতোয়া দিয়েছে। উভয়েই পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা অর্জন করেছেন। উভয়ে পশ্চিমা পোশাক পরিধান করতেন। উভয়ে উকিল ছিলেন। উভয়েই ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তবে উভয়েই অন্যদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গোলামি থেকে মুসলমানদের মুক্ত দেখতে চাইতেন।

আফসোস আমরা ইকবাল ও কায়েদে আজমকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য রোলমডেল বানিয়ে উপস্থাপন করতে পারিনি। উভয়কে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্ত বানাইনি। উপমহাদেশে ইসলাম ছড়িয়েছেন দাতা গঞ্জবাখশ, আবদুল্লাহ শাহগাজী, লাল শাহবাজ কালান্দার, সচল সারমাস্ত, বাবা ফরীদ গাঞ্জশাকর, শাহ আবদুল লতীফ ভিট্টাই, গোলাম ফরীদ, রহমান বাবা, মাস্ত তাওয়াকালী মাররিসহ অসংখ্য সুফি। লাহোরে বিবি পাকদামানের দরগাহ হজরত রুকাইয়্যা বিনতে আলী এর প্রতি সম্বন্ধযুক্ত। আর তিনি মাহমুদ গজনবীর অনেক আগের। আমরা গজনবী ও ঘুরী মিজাইল বানিয়ে নিজেদের ইতিহাসে বিদ্বেষের রং লাগিয়ে দিয়েছি, অথচ ইকবাল বলেন- চিশতী নে জিস যামীঁ মেঁ পয়গামে হাক সুনায়া-মঈনুদ্দীন চিশতী যে ভূমিতে সত্যের পয়গাম শুনিয়েছেন।

কম মানুষই জানেন, ইকবাল ও কায়েদে আজম উভয়েই হজরত দাতা গাঞ্জবাখশ এর বেশ ভক্ত ছিলেন। কায়েদে আজমও কয়েকবার তার বোন ফাতেমা জিন্নাহকে সাথে নিয়ে তার মাজারে গেছেন। ইকবালের হজরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী (শেখ আহমদ সেরহিন্দী) এর প্রতি ভালোবাসা গোপন ছিল না। কায়েদে আজমের পরিবারের এই বুজুর্গের প্রতি বেশ শ্রদ্ধা ভক্তি ছিল। কায়েদে আজমের পূর্বপুরুষরা হজরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী থেকে বায়আত নিয়েছিলেন। তিনি সেই বুজুর্গ, যিনি মোগল সম্রাট জালালুদ্দীন আকবরের দীনে ইলাহীকে প্রতিহত করেন। এ কারণেই ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যখন অখণ্ড ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন তার বক্তৃতায় আকবরের উদারনীতির কথা উল্লেখ করেন তখন কায়েদে আজম জবাবে তাকে বলেন, আমরা উদারনীতির সবক আকবরের কাছে নয়, বরং নবী মোহাম্মদ সা:-এর কাছে শিখেছি। আফসোস, পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কায়েদে আজমের এ বক্তৃতা পড়ানো হয় না। মাউন্ট ব্যাটেন আকবরের সাথে আমাদের সম্পর্ক সংযোগের চেষ্টা করেছেন। অথচ আমাদের সংযোগ স্থাপন করা উচিত যারা এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছেন প্রথমে। আমাদের নিজেদের আসল ইতিহাসের দিকে ফিরে যেতে হবে, যা ব্রিটিশ শাসনামলে বিকৃতি করা হয়েছে। আমাদের শুধু আইএমএফ থেকে নয়, বরং নব্য ঔপনিবেশিক ইতিহাস থেকেও স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১৪ আগস্ট, ২০২২ হতে
উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877