স্বদেশ ডেস্ক:
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে গতকাল শনিবার থেকে কোভিড ১৯-এর বিনামূল্যে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছে ভারত, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকাদান কর্মসূচিও। এদিন ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মসূচি শুরু হয়। কর্মসূচির প্রথম ধাপে করোনা মোকাবিলায় সম্মুখসারিতে কাজ করা তিন কোটি মানুষকে টিকা দেবে দেশটি। এ তালিকায় স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়াও নাম আছে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, সেনাবাহিনী ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মীদের।
ভারত সরকার দেশের মানুষের জন্য দুটি টিকাকে অনুমোদন দিয়েছে। একটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা কোভিশিল্ড এবং ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাকসিন। যার মধ্যে কোভিশিল্ড উৎপাদন করছে ভারতেরই কোম্পানি সেরাম ইনস্টিটিউট। দুটি টিকাই দুই ডোজ করে গ্রহীতাকে দেওয়া হবে। গতকাল যারা টিকা গ্রহণ করেছেন তাদের আবার ২৮ দিন পর এর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে।
এদিন রাজধানী দিল্লির একটি কেন্দ্রে প্রথম ভারতীয় নাগরিক হিসেবে কোভিড ১৯-এর টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণ করেন অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সের (এআইএমএস) পরিচ্ছন্নতাকর্মী মনিশ কুমার। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনের উপস্থিতিতে মনিশকে এ টিকা দেওয়া হয়। পরে এআইএমএস প্রধান রণদীপ গুলেরিয়াও টিকা গ্রহণ করেন। টিকা নেওয়ার পর প্রতিক্রিয়ায় মনিশ বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলাম, আমি টিকা নিতে চাই। কারণ আমি চাই, টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ভয় রয়েছে তা দূর হোক। এটি নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার পরিবারও ভীত ছিল আমি টিকা নেওয়ার কথা বলাতে। তাদের বলেছি, এ টিকার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে বলেই আমি এটি নিচ্ছি।
গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু উপলক্ষে এদিন সকালে এক ভিডিওবার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এত কম সময়ের মধ্যে নভেল করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করে নজির গড়ায় গবেষক ও বিজ্ঞানীদের ধন্যবাদ জানান। তবে টিকাদান শুরু হলেও সংক্রমণ থেকে বাঁচতে আগের মতোই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে বলে জানান তিনি। মোদি সাফ জানিয়ে দেন, মাস্ক ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলায় কোনো ঢিলেমি চলবে না।
গতকাল কর্মসূচির প্রথম দিন দেশজুড়ে মোট ৩ হাজার ৬টি কেন্দ্রে তিন লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল। যার মধ্যে প্রতিটি কেন্দ্রে অন্তত ১০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে কিনা তা অবশ্য এখনো জানায়নি ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশাবলি অনুযায়ী টিকাদানে ‘কোউইন’ নামের অ্যাপ ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। টিকা নেওয়ার আগে তাতে নাম ও পরিচয় নথিভুক্ত করতে হবে প্রত্যেককে। এ ছাড়া কত টিকা মজুদ রয়েছে, এর জন্য কত ডিগ্রি তাপমাত্রা আদর্শ, কতজন টিকা নিল এবং গ্রহণের পর তাদের শরীরে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে, ওই অ্যাপের মাধ্যমেই সবকিছুতে নজর রাখা হবে। এ ছাড়া টিকাদান শুরুর আগে এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি নির্দেশিকাও প্রকাশ করেছে ভারত সরকার।
ওই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, টিকা গ্রহণকালে কী কী করা যাবে, আর কী নয়। যেমন- টিকা গ্রহীতাকে অবশ্যই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এর দুটি ডোজ গ্রহণ করতে হবে। শুরুতেই এ টিকা দেওয়া হবে ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের। তবে অন্তঃসত্ত্বা বা যারা গর্ভধারণ নিয়ে খুব একটা নিশ্চিত নন এবং যেসব মা শিশুদের বুকের দুধ পান করান তারা টিকা নিতে পারবেন না। আবার একজন ব্যক্তিকে শুধু নির্ধারিত একটি কোম্পানিরই টিকা গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি টিকার প্রথম ডোজ যে সংস্থার নেবেন, দ্বিতীয় ডোজটিও ওই সংস্থারই নিতে হবে। যদি কেউ অন্য রোগের জন্য এর মধ্যে টিকা নিয়ে থাকেন, তা হলে সেটির সঙ্গে কোভিড-১৯ টিকা নেওয়ার মধ্যে সময়ের ব্যবধান ১৪ দিন হতে হবে। এ ছাড়া করোনা পজিটিভ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন এমন ব্যক্তিরা সুস্থ হওয়ার চার-আট সপ্তাহ পর কোভিড ১৯-এর টিকা নিতে পারবেন। অসুস্থ অবস্থায় যাদের প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হয়েছে, তারা টিকা নিতে পারবেন সুস্থ হওয়ার চার-আট সপ্তাহ পর। পাশাপাশি যারা কোনো রোগে আক্রান্ত বা হাসপাতালে ভর্তি; তারা সুস্থ হওয়ার চার-আট সপ্তাহ বাদে টিকা নিতে পারবেন। যারা হৃদরোগ, স্নায়ু বা ফুসফুসজনিত রোগ বা এইআইভিতে আক্রান্ত তারা নিতে পারবেন এ টিকা।
বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও এদিন টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা মিলিয়ে ২০৭টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে টিকাদানের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। আপাতত পশ্চিমবঙ্গে করোনা টিকা হিসেবে কোভিশিল্ড দেওয়া হচ্ছে। প্রথম দফায় টিকাদানে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তবে কর্মসূচির প্রথম দিনেই সফটওয়্যারের সমস্যার কারণে অকার্যকর হয়ে পড়ে কোউইন অ্যাপ। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হয় রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরকে।
এদিকে সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত কোভিশিল্ডের দুটি ডোজ নেওয়ার মধ্যে সময়ের পার্থক্য ২৮ দিনের বেশি হলে এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট একজন বিজ্ঞানী। সেরামের নির্বাহী পরিচালক ড. সুরেশ যাদভ এনডিটিভিকে বলেন, দুই ডোজের মধ্যে ব্যবধান কয়েক সপ্তাহ বাড়ানো গেলে ফল আরও অনেক ভালো হবে। সময়ের ব্যবধান চার সপ্তাহ হলেও এটা ভালো সুরক্ষা দেয়। তবে তা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। কিন্তু ব্যবধানটা যদি আরও বাড়িয়ে ছয় বা আট বা ১০ সপ্তাহ করা যায়, তা হলে ফল হবে উচ্চমাত্রার। এ টিকার তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দুই ডোজের মধ্যে সময়ের পার্থক্য ২৮ দিন হওয়ায় সেভাবেই টিকা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। তবে দ্বিতীয় ডোজ যদি আগে নেওয়া হয়, তাতেও সেই ব্যক্তির ৭০ শতাংশ সুরক্ষা হবে বলে জানান ড. সুরেশ।
অন্যদিকে ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাকসিন নিয়েও যে সংশয় মানুষের মধ্যে আছে, তা দূর করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ টিকা নিচ্ছেন যারা, তাদের সই করতে হচ্ছে একটি অনুমতিপত্রে। সেখানে লেখা শর্তাবলি মেনে চলার প্রতি প্রতিশ্রুতি দিতে হচ্ছে তাদের। পাশাপাশি যদি কোনো মানুষের শরীরে টিকার কারণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তা হলে তার ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে ওই অনুমতিপত্রে। এই ক্ষতিপূরণের মাত্রা ঠিক করবে আইসিএমআরের এথিকস কমিটি।
ভারত এমন এক সময়ে এই টিকাদান কর্মসূচি শুরু করল, যখন করোনা আক্রান্তের সংখ্যায় দেশটি বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। ভারতে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ৫ লাখ ৪৩ হাজারেরও বেশি, মারা গেছেন ১ লাখ ৫২ হাজারের বেশি মানুষ।