আবু তাহের খান :
দেশে বিরাজমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মূল দুশ্চিন্তা এখন তিনটি: কখন যান চলাচল পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে; দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে এবং দেশে বিরাজমান আতঙ্কজনক পরিস্থিতি আবারও হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কিনা। তবে জীবন-জীবিকাভিত্তিক এসব উদ্বেগের বাইরে রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিক হিসাবে মানুষের মধ্যে কিছু প্রত্যাশাও রয়েছে, যেমন রাষ্ট্রের সাবেক ও বর্তমান কর্মচারীদের বিশাল সব দুর্নীতির যেসব খবরা-খবর গণমাধ্যমের সুবাদে জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো যেন চলমান অস্থিরতার কারণে ধামাচাপা পড়ে না যায়। রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের মধ্যে সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান আজিজ আহমেদ, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। দেশের সাধারণ মানুষ এখন এদের সবাইকেই কম-বেশি চিনে এবং আশা করে, যথাযথ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবশ্যই তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
উল্লিখিত ব্যক্তিরা ছাড়া আরও বেশকিছু রাষ্ট্রীয় কর্মচারীর বিরুদ্ধে সম্প্রতি অনুরূপ দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে তদন্তও শুরু করেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জনমতের চাপে উল্লিখিত তদন্তগুলো যখন মোটামুটি এগোচ্ছিল, ঠিক সে সময়েই চলমান অস্থিরতার চাপে পড়ে হঠাৎ করেই তা থমকে গেল বলেই মনে হচ্ছে। অবশ্য শুরু হওয়া তদন্তও শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন হবে কিনা, তদন্ত সচল থাকা অবস্থায় সে আশঙ্কাও সাধারণ মানুষের মধ্যে যথেষ্টই ছিল। আর সে আশঙ্কার সঙ্গে এখন নতুন করে যুক্ত হলো দেশের সাম্প্রতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির ফাঁকে পড়ে দুর্নীতির উল্লিখিত সব বিষয়ই শেষ পর্যন্ত চাপা পড়ে যাবে না তো! আর সে আশঙ্কা থেকেই সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের (সরকারের) দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই মূলত এ প্রবন্ধের অবতারণা।
আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে আনীত আর্থিক ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগের চেয়েও অধিকতর উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এটি পুরো সেনাবাহিনীর মর্যাদা ও ভাবমূর্তিকে কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যদিও ব্যক্তিবিশেষের দুর্নীতি ও অপকর্মের দায় কোনোভাবেই পুরো বাহিনীর ওপর বর্তায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে; সাধারণ মানুষের মনের ভেতরে কখনো যেন অবচেতনভাবে হলেও সেনাবাহিনীর ব্যাপারে কোনোরূপ সন্দেহ চলে না আসে। তেমন কিছু ঘটলে বাহিনী সদস্যরা হয়তো স্বাভাবিকভাবেই হতাশা ও মনোকষ্টে ভুগবেন। তবে শেষ পর্যন্ত যদি যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সঠিক প্রমাণিত হয় ও সে অনুযায়ী তাকে শাস্তির আওতায় আনা যায়, তাহলে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি পরিপূর্ণভাবেই রক্ষা পাবে বলে আশা করা যায়।
পুলিশ বাহিনীতে সৎ ও দক্ষ সদস্য থাকলেও সাধারণভাবে বাংলাদেশে পুলিশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও মলিন। এমনকি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির পর্বতপ্রমাণ অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার আগেও এই মলিন ভাবমূর্তি এমনই ছিল। তবে বেনজীরের নানা কাণ্ডকারখানা সামনে আসার পর এখন বোঝা যাচ্ছে, চাকরিতে থাকা অবস্থায় সে কত বড় ছদ্মবেশী প্রতারক ছিল! পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন, শুদ্ধাচার পুরস্কার লাভ, দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ইত্যাদি হেন কোনো ছদ্মবেশ নেই, যা সে নেয়নি। তো এ রকম একজন প্রতারক যদি দেশের অস্থির পরিস্থিতির সুযোগে দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়, তাহলে তা হবে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তারচেয়েও বড় কথা, এর মধ্য দিয়ে দেশে দুর্নীতি ও প্রতারণা-দুই-ই ব্যাপকভাবে প্রশ্রয় পাবে ও সে কারণে তা বহুলাংশে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বেনজীরের ব্যাপারে পাদটীকার মতো করে বলি, এসব দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নাকি বেশ বহাল তবিয়তেই ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই কারও কারও বিরাগভাজন হয়ে পড়াতেই নাকি তিনি পরম যত্ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে তোলা মসনদটিকে আকস্মিকভাবে হারিয়ে ফেলেন।
এনবিআরের প্রবাদপুরুষ মতিউর তো রীতিমতো জনপ্রিয় এক মহানায়ক। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে নিয়েই শুধু হজে যাননি-এ জাতীয় নানা পুণ্যের কাজ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা আরও অনেককে নিয়েই করেছেন। ফলে যেভাবেই হোক, তার বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত যাতে ঠেকিয়ে দেওয়া যায়, তজ্জন্য তার অনেক সতীর্থ পুণ্যার্থী রাষ্ট্রের কাছে তো বটেই-এমনকি স্রষ্টার কাছেও হয়তো প্রার্থনা জানাবেন। আর তার সেসব ক্ষমতাধর সুহৃদরা রাষ্ট্রের এ অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে যে নানাভাবে সুযোগ নিতে অর্থাৎ মতিউরকে বাঁচিয়ে দিতে চাইবেন, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় দেশের গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষ যদি তার ও তার পোষ্যদের দুর্নীতির নানা খবরাদি আরও বেশি করে জনসমক্ষে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে সেসবের চাপে তার সুহৃদরা হয়তো তাকে রক্ষা করতে কিছুটা হলেও নিরস্ত থাকবে।
সাবেক পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালক আবেদ আলীর দুর্নীতির বিভিন্ন খবরাখবর এবং দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ ব্যবহার করে তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টাসংক্রান্ত নানা ঘটনা বস্তুতই কৌতূহলোদ্দীপক। রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তার মেলামেশা ও সেসব ব্যক্তির সঙ্গে ওঠানো তার হৃদ্যতাপূর্ণ ভঙ্গিমার নানা ছবি দেখে ধারণা করা চলে, বিভিন্ন ধরনের অবৈধ ও অনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্যই তিনি এসব করেছেন। অন্যদিকে এসব থেকে এটাও প্রমাণিত হয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের অনেকেই ‘তলে তলে’ নানা হীন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কিংবা হীন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তারা প্রশ্রয়দাতা। দুদক পিএসসির প্রশ্নফাঁস নিয়ে ইতোমধ্যে যে তদন্ত শুরু করেছে, তা যদি নির্বিঘ্নে অব্যাহত থাকে, তাহলে এ সংক্রান্ত অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্যই হয়তো জনসমক্ষে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এক্ষেত্রে পক্ষপাতহীন নির্বিঘ্ন তদন্তের কাজটি এগোতে পারবে তো? কিংবা দেশের অস্থির পরিস্থিতিতে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যাবে না তো? তবে শেষ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে কী ঘটবে, তা কেবল সময়ই বলতে পারবে। তবে একটি বিষয় সময়ের জন্য অপেক্ষা না করে বলাই যায়, আবেদ আলী যার গাড়িচালক ছিলেন, তার প্রশ্রয় ও সমর্থন ছাড়া এ ধরনের দুর্নীতি কখনোই ঘটতে পারে না। ফলে ওই গাড়ির আরোহীও এসব দুর্নীতির দায় এড়াতে পারেন না।
জাহাঙ্গীর আলম পিয়ন ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। আর প্রধানমন্ত্রী নিজেই জানিয়েছেন, তিনি শুনেছেন তার পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম নাকি দুর্নীতি করে ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে এবং তা শোনার পরপরই তিনি তাকে বের করে দিয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণাকারী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ পিয়ন জাহাঙ্গীর আলমকে তাৎক্ষণিকভাবে বের করে দিয়ে খুবই উত্তম কাজ করেছেন। এ অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জনগণের প্রত্যাশা থাকবে, কার্যক্ষেত্রে অবস্থানের সুবিধা নিয়ে জাহাঙ্গীর আলমের মতো ধূর্ত ব্যক্তিরা ঊর্ধ্বতনের নাম ভাঙিয়ে কীভাবে দুর্নীতি করেন, অতি কাছ থেকে তা দেখার সুবাদে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যেন সেসব কৌশলের বিষয়ে দুদককে পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করেন। তার এ ধরনের দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ অন্যান্য দুর্নীতির তথ্য উদ্ঘাটনেও ব্যাপকভাবে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। আর দুদকেরও উচিত হবে, জাহাঙ্গীর আলমকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে তার বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দিকনির্দেশনা গ্রহণ।
সব মিলে সার্বিক প্রত্যাশা এই যে, দেশের অস্থির অবস্থাকে সুযোগ হিসাবে কাজে লাগিয়ে ওই ধূর্ত দুর্নীতিবাজরা যেন কোনোভাবেই নিজেদের আড়াল করার সুযোগ না পান। এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি দেশের জনগণ ও সংশ্লিষ্ট অন্য সবাইকেও সচেতন থাকতে হবে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিও আহ্বান থাকবে, তারা যেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুরু হওয়া তাদের নানাবিধ তদন্ত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কোনোরূপ শৈথিল্য প্রদর্শন না করে। মোট কথা, আজিজ-বেনজীর-মতিউর-আবেদ আলীদের দুর্নীতি ও অপকর্মের কথা অত সহজেই যেন আমরা ভুলে না যাই। বরং আমরা চাই, ওই দুর্নীতিবাজরা যেন এ দেশের সাধারণ জনগণের ঘৃণা ও প্রতিবাদের আগুনে পুড়ে নিঃশেষ ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
আবু তাহের খান : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা (বিসিক)