স্বদেশ ডেস্ক:
শুধু বড় গ্রাহকরাই নয়, ছোট ও মাঝারি গ্রাহকরাও যথাসময়ে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। এ ছাড়া গাড়ি ক্রয়, গৃহনির্মাণ ও ব্যক্তিগত ঋণসহ সব ধরনের খুচরা ঋণ ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। ফলে এ ধরনের ঋণও একসময় খেলাপি হয়ে পড়ছে এবং তা আদায়েও ব্যাংকগুলোকে বাধ্য হয়ে মামলা করতে হচ্ছে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই এসব ছোট অঙ্কের ঋণের মামলা পরিচালনার খরচ বেশি হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মামলা ছাড়াই এ ধরনের ঋণ অবলোপনের সুযোগ চান ব্যাংকাররা। এ জন্য খেলাপি ঋণ অবলোপনের সীমা দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করেছেন তারা।
গত মাসে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদায়ী গভর্নর ফজলে কবির।
এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘মামলা করি আর না করি বা ঋণের পরিমাণ যাই হোক না কেন, ঋণগ্রহীতাকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ঋণ অবলোপন করে আলাদা হিসাবে নেওয়া হলেও আদায় কার্যক্রম অব্যাহত রাখে ব্যাংকগুলো। তা ছাড়া ঋণ যত সময় আদায় না হবে, তত সময় তা আয় খাতেও নেওয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া শতভাগ প্রভিশনিং করেই ঋণ অবলোপন করা হয়। কাজেই ছোট ঋণের ক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণের তুলনায় যদি মামলা পরিচালনার খরচ বেশি হয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে ব্যাংক ক্ষতির মুখে পড়ে। তাই মামলা ছাড়া ঋণ অবলোপনের সীমা বাড়ানো উচিত।
জানা যায়, দেশের অর্থঋণ আদালতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ আদায়সংক্রান্ত মামলার পাহাড় জমেছে। বর্তমানে দেশের ৬০টি তফসিলি ব্যাংক ও ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুই লক্ষাধিক মামলা চলমান রয়েছে। এসব মামলায় আটকে আছে প্রায় সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা। বছরের পর বছর এসব মামলা ঝুলে থাকলেও নিষ্পত্তিতে তেমন গতি নেই। মামলাগুলোতে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা কমে যাওয়াসহ তাদের নিয়মিত কার্যক্রমে গতিশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এ অবস্থায় খেলাপি ঋণ আদায়ে দায়ের করা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গত মে ও জুন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তিনটি প্রাক-পর্যালোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পর্যাপ্ত অর্থঋণ আদালত স্থাপনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, বিকল্প বিরোধের বিধান প্রয়োগ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ‘র্যাপিড রিকভ্যারি টিম’ গঠন এবং প্যানেলভুক্ত আইনজীবীদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আনুপাতিক হারে মামলা প্রদানসহ ১১টি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
পরে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়। এতে ছোট ও মাঝারি খাতের ঋণ এবং খুচরাসংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। সভায় বলা হয়, ছোট ছোট নিরাপত্তাহীন ব্যক্তিগত ঋণও অবলোপন করার পূর্বশর্ত হচ্ছে মামলা করা। এ ক্ষেত্রে মামলা করার জন্য ঋণের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র দুই লাখ টাকা। কিন্তু দায়েরকৃত মামলাগুলোর পরিচালনা ব্যয় অত্যন্ত বেশি; মামলার সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়টি বিবেচনায় এসব ঋণ অবলোপন করার ক্ষেত্রে ঋণের সীমা বৃদ্ধি করে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করার অনুরোধ জানান ব্যাংকাররা।
এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, শুরুতে মামলা ছাড়াই ঋণ অবলোপনের সীমা ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তী সময়ে তা বৃদ্ধি করে এক লাখ এবং আরও পরে দুই লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে খুচরা ঋণের ক্ষেত্রে এই সীমা বৃদ্ধি করা যায় কিনা সে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। এ সময় এবিবির চেয়ারম্যানসহ অন্য ব্যাংকের এমডিরা এই সীমা বৃদ্ধির পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, এ বিষয়ে এবিবির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রস্তাব দাখিল করার পর বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা হবে।
এদিকে ঋণ অবলোপনের সুযোগ রাখাকে বরাবরই অস্বচ্ছ বলে মন্তব্য করে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, ঋণ অবলোপনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো নিজেদের আর্থিক অনিয়মও আড়াল করছে। তা ছাড়া একবার কোনো ঋণ অবলোপন করা হলে তা আদায়ের জন্য খুব বেশি চেষ্টা করা হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ অবলোপনের পুঞ্জীভূত স্থিতি ছিল ৫৯ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। এই ঋণ থেকে গত ১৯ বছরে আদায় হয়েছে ১৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ২০৭ কোটি টাকা, আদায়ের হার দশমিক ৪৭ শতাংশ। ফলে খেলাপি ঋণ অবলোপনের নিট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। অবলোপনের কারণে এই পরিমাণ ঋণ আর ব্যাংকের মূল হিসাবে দেখাতে হচ্ছে না। এটি বিবেচনায় নিলে ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়াত এখন প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।