শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৩৯ অপরাহ্ন

খেলাপিদের পথে হাঁটছে নিয়মিতরাও

খেলাপিদের পথে হাঁটছে নিয়মিতরাও

স্বদেশ ডেস্ক:

বারবার সুবিধা দিয়েও ঋণের টাকা আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। খেলাপিদের পাশাপাশি নিয়মিত গ্রাহকরাও ঋণ ফেরতে টালবাহানা করছেন। ফলে প্রতিনিয়তই ব্যাংকের ঋণ আদায় কমে যাচ্ছে, বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে ঋণখেলাপিদের থেকে দেশের ব্যাংকগুলোর আদায়ের হার মাত্র পৌনে ২ শতাংশ। এর মধ্যে ২৫টি ব্যাংকের আদায়ের হার নাজুক। এই ২৫ ব্যাংকের মধ্যে ১৬টির আদায়ের হার ১ শতাংশেরও কম, যাকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করা হয়েছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে। অন্যদিকে এ সময়ে নিয়মিত ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর আদায়ের হার ছিল ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে ১০টি ব্যাংকের আদায়ের হার ৩ শতাংশেরও কম, যার মধ্যে চারটির আদায় শূন্য। ঋণ আদায়ের এমন নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেই সম্প্রতি খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিলে আবার ঢালাও ছাড় দেওয়া হয়েছে। এর আগে ব্যাংকের সব গ্রাহকের ঋণের কিস্তি পরিশোধে টানা দুই বছর সুবিধা দেওয়ার পর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে তা তুলে নেওয়া হয়েছিল। তবে তিন মাস যেতেই ব্যবসায়ীদের চাপে সেই সুবিধা আবার অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, দেশে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার যে প্রবণতা, সেটা বড় গ্রাহকদের ক্ষেত্রেই বেশি পরিলক্ষিত হয়। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকার পরও নানা টালবাহানায় ঋণ ফেরত দেন না। তারপরও ঋণ পরিশোধে বারবার ছাড় পাচ্ছেন তারা। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ঋণ আর ফেরত আসছে না। তিনি আরও বলেন, বড়দের নানা কানেকশন থাকে। ফলে তারা ঋণ ফেরত না দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সরকারেরও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।

২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার আঘাত আসার পর ব্যবসাবাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে প্রণোদনার ঋণ দিয়ে সহযোগিতার পাশাপাশি ওই বছরজুড়েই ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। ফলে ওই বছর বকেয়া ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ না করেও কেউ খেলাপি হননি। ২০২১ সালে এই সুবিধা বহাল রাখা না হলেও ঋণ পরিশোধে ছাড় অব্যাহত রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। বকেয়ার ঋণের মাত্র ১৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধে করলেই খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে খেলাপিমুক্ত থাকার সব ধরনের শিথিলতা তুলে নেওয়া হয়েছিল। আর তাতেই ঋণ পরিশোধ কমে বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ। এর জন্য করোনার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ও পুনরায় সংক্রমণ বৃদ্ধি, দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সৃষ্ট বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবকে দায়ী করে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড় আবার ছাড় দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, এবার যেসব ঋণ গত ১ এপ্রিল নিয়মিত ছিল, শুধু সেসব ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে জুন, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর প্রান্তিকে বড় ঋণের বিপরীতে যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করার কথা, যথাক্রমে তার ৫০, ৬০ ও ৭৫ শতাংশ পরিশোধ করলে ঋণগুলো আর খেলাপি হবে না। আর কৃষি ও সিএমএসএমই ঋণে যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা তার ২৫, ৩০ ও ৪০ শতাংশ পরিশোধ করে খেলাপিমুক্ত থাকা যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ছাড় তুলে নেওয়ার পরই চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ওই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। শুধু পরিমাণের দিক থেকেই নয়, শতাংশ হিসাবেও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায়। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ, যা মার্চে বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সব মিলে গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায় করতে সক্ষম হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। আদায়ের হার ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আগের প্রান্তিক গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর আদায়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৭২ কোটি টাকা, আদায়ের হার ছিল ২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা, আদায়ের হার ছিল ২ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর মানে বিশেষ সুবিধা চলাকালীন সময়ে খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর আদায়ের পরিমাণ বেশি ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, খেলাপিমুক্ত থাকতে বকেয়া কিস্তির ১৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধের সুযোগ নেওয়ার কারণে আগের প্রান্তিকগুলোকে আদায়ের পরিমাণ বেশি ছিল। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রান্তিকে এই ছাড় তুলে নেওয়ার কারণে কিস্তি পরিশোধে আগ্রহ কমে যায় সবার। এ ছাড়া বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ের তৎপরতাও কম থাকে। সব মিলে ব্যাংকগুলোর আদায় কমে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে।

প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, ২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) চেয়ে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে রাষ্ট্রায়ত্ত, বেসরকারি ও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায়ের হার নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে। এ সময়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকেও ছিল ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ দশমিক ১৯ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকের আদায়ের হার ১ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ১ দশমিক ১৯ শতাংশ। তবে এ সময়ে বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকের আদায় পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আগের প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর আদায়ের হার যেখানে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল, যা মার্চ প্রান্তিকে বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এ সময়ে খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২৫টি ব্যাংকের আদায়ের হার ছিল দেড় শতাংশের নিচে। ব্যাংকগুলো হলো- ইউনিয়ন ব্যাংক দশমিক ১২ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক দশমিক ২৪ শতাংশ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক দশমিক ৩২ শতাংশ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক দশমিক ৩৪ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংক দশমিক ৩৫ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংক দশমিক ৩৮ শতাংশ, পদ্মা ব্যাংক দশমিক ৪২ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক দশমিক ৪৮ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংক দশমিক ৫১ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দশমিক ৬৮ শতাংশ, এবি ব্যাংক দশমিক ৭০ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংক দশমিক ৭৯ শতাংশ, সাউথইস্ট ব্যাংক দশমিক ৮৫ শতাংশ, আল আরাফাহ ব্যাংক দশমিক ৯০ শতাংশ, সাউথ বাংলা দশমিক ৯২ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংক দশমিক ৯৮ শতাংশ, ইষ্টর্র্ণ ব্যাংক ১ দশমিক ০৩ শতাংশ, কমিউনিটি ব্যাংক ১ দশমিক ৩ শতাংশ, পূবালী ব্যাংক ১ দশমিক ১৯ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংক ১ দশমিক ২২ শতাংশ, ট্রাস্ট ব্যাংক ১ দশমিক ২৪ শতাংশ, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ১ দশমিক ২৮ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংক ১ দশমিক ২৯ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ ও যমুনা ব্যাংক ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

অন্যদিকে নিয়মিত তথা অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতেও মার্চ প্রান্তিকে আদায় কমেছে রাষ্ট্রায়ত্ত, বেসরকারি ও বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকের। এ সময়ে অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে বেসরকারি ব্যাংকের আদায়ের হার ১৮ দশমিক ২৮ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আদায়ের হার ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকের আদায়ের হার ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ; যা আগের প্রান্তিকে ছিল ১৮ দশমিক ৩১ শতাংশ। তবে অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে বিদেশি খাতের ব্যাংকের ঋণ আদায় তুলনামূলক বেড়েছে। মার্চ প্রান্তিকে বিদেশি খাতের ব্যাংকের আদায়ের হার ৩৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৩৩ দশমিক ২৭ শতাংশ।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877