শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১২:২৩ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
হেফাজত নায়েবে আমিরের চিঠি নিয়ে কওমি অঙ্গনে তোলপাড়

হেফাজত নায়েবে আমিরের চিঠি নিয়ে কওমি অঙ্গনে তোলপাড়

স্বদেশ ডেস্ক:

হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির ও দেওনার পীর অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরীর প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া এক চিঠি নিয়ে কওমি অঙ্গনে তোলপাড় চলছে। সরকারপ্রধানকে দেয়া এ চিঠিকে কওমির স্বকীয়তা নষ্ট করার একটি অপচেষ্টা বলে মনে করছেন কওমির শীর্ষ আলেমরা। সে জন্য এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ১০ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা বৈঠকে আল-হাইআতুল উলয়ার অধীন ৬ বোর্ডের কর্মকর্তারা না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; যা ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে লিখিত আকারে জানিয়ে দিয়েছেন তারা।

জানা যায়, গত ২৫ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠি দেন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির ও দেওনার পীর অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ১০ আগস্ট একটি সভা ডেকেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই সভায় অংশ নিতে গত ৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কওমি মাদরাসার বোর্ডপ্রধানদের সভায় আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়।

উপসচিব মো: শামীম হাসান স্বাক্ষরিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, গত বছর (২০২১) ২৬, ২৭, ২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সংঘটিত হয়। এ বিষয় অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে দেয়া সুপারিশের আলোকে পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং চলতি বছর গত ২৫ জুন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমিরের পাঠানো চিঠির সুপারিশের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে সভাটি অনুষ্ঠিত হবে। এ ঘটনার পরই তোলপাড় শুরু হয় কওমি অঙ্গনে। হেফাজতে ইসলামের আমির ও মহাসচিব গত শনিবার এক বিবৃতিতে সংগঠনের নায়েবে আমিরের এ চিঠির বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে জানান, এটি হেফাজতের পক্ষ থেকে লিখিত কোনো চিঠি নয়। চিঠির বিষয়টি হেফাজতের কোনো ফোরামে আলোচনা করে তিনি পাঠাননি। এটি একান্তই তার ব্যক্তিগত। এর সাথে হেফাজতের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে আল-হাইআতুল উলয়ার অধীন ৬ বোর্ডের কর্মকর্তারাও শনিবার এক জরুরি বৈঠকে বসেন। তারা বৈঠক থেকে অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানের চিঠিকে এখতিয়ারবহির্ভূত বলে জানান। সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে না যাওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়; যা ওই দিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করে লিখিত আকারে জানিয়ে দিয়েছেন তারা।

কী আছে হেফাজতের নায়েবে আমিরের চিঠিতে : বাংলাদেশ কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষা ও শিক্ষকের মান উন্নয়নকল্পে আটটি সুপারিশ করে গত ২৫ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠি দেন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির ও দেওনার পীর অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী।

সুপারিশগুলো হচ্ছে-০১. কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষার মান উন্নয়নে আপনি (প্রধানমন্ত্রী) দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মর্যাদা দিয়ে সনদের ব্যবস্থা করেছেন এবং এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য জাতি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। ওই আইনে কওমি শিক্ষার সূচনা অর্থাৎ প্রাথমিক স্তরের ভিত্তি উল্লেখ নেই, সাধারণ শিক্ষায় যেমনটি আছে। কওমি শিক্ষা আইনে এ বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাটি ভবিষ্যতে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীন ‘কওমি মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের (তাকর্মীল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির (ইসলামিক স্টাডিস ও আরবি) সমমান প্রদান আইন, ২০১৮’এর ২(১) ধারায় ‘কওমি মাদরাসা’ এর সংজ্ঞায় বর্ণিত ‘কওমি মাদরাসা’ অর্থ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আত ও দারুল উলূম দেওবন্দের আদর্শ, মূলনীতি ও মত-পথের অনুসরণে মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক সহায়তার উলামায়ে কেরামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইলমে ওহির শিক্ষাকেন্দ্র;’ উক্ত ধারার সাথে ‘যেখানে মক্তব, নাজেরা, হেফজ থেকে শুরু করে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত এবং তৎপর ইফতা, উলুমুল হাদিস, তাফসিরসহ উচ্চতর শিক্ষা দেয়া হয়’ সংযুক্ত করা আবশ্যক।
০২. কওমি ধারার শিক্ষা একটি বিশেষায়িত শিক্ষাব্যবস্থা। এর শিক্ষক ও শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রতিটি শিক্ষকের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। জাতীয়ভাবে বা ব্যক্তি উদ্যোগে ‘কওমি মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করা খুবই প্রয়োজন।

০৩. যেহেতু কওমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের আর্থিক সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে, সে কারণে মাদরাসার সকল প্রকার দান আয়কর মুক্ত থাকা দরকার। এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করলে দাতারা উৎসাহের সাথে কওমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দান করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন।
০৪. মাদরাসার নিজস্ব আয় থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ড ফান্ড গঠন, স্বল্প আয়ের শিক্ষকদের মাসিক বেতন নিয়মিত পরিশোধ করা, মেধাবী, এতিম, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা।

০৫. কোনো সরকারপ্রধানের উদ্যোগে একই সাথে ৪৬০টি উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ একটি বিশ্বরেকর্ড। এসব মসজিদে ইমাম ও খতিব নিয়োগের ক্ষেত্রে কওমি মাদরাসা থেকে পাস করা মেধাবী আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদার অনুসারীদের ইমাম খতিব নিয়োগ প্রদানে অগ্রাধিকার দেয়া এবং নিয়োগ বোর্ডে স্থানীয় কওমি মাদরাসা থেকে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা যেন ভিন্ন মতাদর্শীরা নিয়োগ পেতে না পারে। তাহলে সরকারের প্রদত্ত স্বীকৃতি বাস্তবে আরো প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সরকারের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল হবে।

০৬. কওমি শিক্ষাঙ্গন এবং সংশ্লিষ্ট ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারীদের সকল প্রকার প্রচলিত রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
০৭. সকল কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেফাক ও হাইআতুল উলইয়ার আওতাভুক্ত করে তার নীতিমালার আলোকে পরিচালনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা; যাতে ছাত্রদের পড়ালেখার মান নিশ্চিত করা যায়।

০৮. এসব বিষয় বাস্তবায়িত হলে এবং প্রতিটি কওমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখলে ব্যক্তি ও জাতি গঠনে কওমি মাদরাসাগুলো অনেক বেশি অবদান রাখতে পারবে। পাশাপাশি জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, মাদক নির্মূল ও সামাজিক অবক্ষয় রোধে তৃণমূল পর্যায়ে মাদরাসাগুলোর উলামায়ে কেরামের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। এ বিষয়ে মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিবিধান প্রণয়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

আল-হাইআতুল উলয়ার সিদ্ধান্ত : দেশের কওমি মাদরাসাগুলো সর্বোচ্চ সংগঠন আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কাওমিয়া শনিবার এক জরুরি বৈঠকে বসে। সভার বিষয়ে গতকাল এক বিবৃতিতে জানানো হয়, আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের স্থায়ী কমিটির সভায় কওমি মাদরাসা সম্পর্কে সরকার বরাবর অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরীর সুপারিশকে এখতিয়ারবহির্ভূত।

সভায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয় : ০১. ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে সংঘটিত কার্যকলাপের সাথে আল-হাইআতুল উলয়ার অধীন ৬ বোর্ডের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। একইভাবে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মিজানুর রহমান চৌধুরী, আল-হাইআতুল উলয়া ও ৬ বোর্ডের কেউ নন। তার পাঠানো পত্রের সুপারিশমালা একান্তই তার ব্যক্তিগত, আল-হাইআতুল উলয়ার অধীন ৬ বোর্ডের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
০২. যেহেতু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের ১০ আগস্টের সভার আলোচ্য বিষয় দু’টির সাথে আল-হাইআতুল উলয়ার অধীন ৬ বোর্ডের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, সে জন্য ওই সভায় অংশগ্রহণে ৬ বোর্ডের পক্ষ হতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়।

এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সভায় এক প্রস্তাবে বলা হয়, কওমি মাদরাসার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা রক্ষা করে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে যে আইন (২০১৮ সালের ৪৮ নং আইন) পাস হয়েছে তা অক্ষুণ্ন রাখতে উলামায়ে কেরাম প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর ব্যতিক্রম কিছু উলামায়ে কেরাম, কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা এবং জাতির কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই কওমি মাদরাসার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রাখতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি বিশেষভাবে আহ্বান জানানো হয় এবং এ বিষয়ে মাদরাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদেরকে কোনো ধরনের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।

আল-হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির গতকালের সভায় উপস্থিত ছিলেন কো-চেয়ারম্যান আল্লামা শেখ সাজিদুর রহমান, মাওলানা মুফতি রুহুল আমীন, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা আব্দুল হামীদ (পীর সাহেব, মধুপুর) প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এ বিষয়ে হেফাজতের নায়েবে আমির ও দেওনার পীর অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বরাবর দেয়া চিঠিতে আমি কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষা ও শিক্ষকের মান উন্নয়নকল্পে আটটি সুপারিশ করেছি। এ বিষয়টি আমি হেফাজতের সভায় জানিয়েছিলাম। কিন্তু ফোরাম আমলে নেয়নি। এ কারণেই আমি নিজে এ উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি বলেন, আমি হাইআতুল উলয়া ও বেফাকের কর্মকর্তা নই। তবে আমি ৩২ বছর ধরে কওমি শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করছি, কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে মুহতামিম হিসেবেও আছি। এ জন্য আমি সমস্যাগুলো প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যেহেতু দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মান দিয়েছেন তিনিই পারবেন অন্যান্য বিষয়েও উন্নয়ন করতে। কিন্তু এখন দেখছি বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। অনেকে নানা কথা বলছেন। কিন্তু আমি আমার বক্তব্যে দুঃখিত নই। আমি আমার জায়গা থেকে একচুলও নড়ব না। তিনি আরো বলেন, সরকার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। সদয় মনোভাব নিয়ে দেখছে বলেই মিটিং ডেকেছে। যেখানে সব সংস্থার কর্মকর্তারাও থাকবেন। তবে তাকে ওই মিটিংয়ে ডাকা হয়নি বলে তিনি জানান।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877