স্বদেশ ডেস্ক:
এ যেন ‘মরেও শান্তি নেই’। জাগতিক দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার পরও স্বজনেরা তাদের শেষ বিদায় জানাননি কিংবা জানাতে পারেননি। তাদের কেউ হাসপাতালে মারা গেছেন, কারো বা হয়েছে অপমৃত্যু।
আইনি জটিলতায় আটকে গেছে অন্তিম শয়ান, তাই তাদের ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের লাশ কাটা ঘরে।
বছরের পর বছর হিমঘরে কাটিয়ে দিচ্ছেন তারা।
চার বছর মর্গে থেকে জুনে গাজীপুরে সমাহিত হয়েছেন রবার্ট মাইরন বার্কার
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক রবার্ট মাইরন বার্কারের লাশ চার বছর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে থাকার পর এ বছরের ২৪ জুন গাজীপুরের একটি চার্চে সমাহিত করা হয়।
পেশায় একজন বিদেশি উন্নয়নকর্মী বার্কারের সাথে বাংলাদেশী মাজেদা খাতুনের বিয়ে হয় ২০১৪ সালের ১ এপ্রিল।
২০১৮ সালের ২৫ মে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার দক্ষিণখানের একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান।
ময়নাতদন্তের পর তাকে কোথায় সমাহিত করা হবে তা নিয়ে জটিলতা শুরু হয়।
বিদেশি নাগরিক হওয়ায় দূতাবাসের ছাড়পত্র ছাড়া তার লাশ এদেশে সমাহিত করা যাচ্ছিল না।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে বিবিসিকে বার্কারের বাংলাদেশী স্ত্রী মাজেদা খাতুন বলেছিলেন, বার্কারের অসুস্থতা ও মৃত্যুর সংবাদ যুক্তরাষ্ট্রে তার পরিবারকে জানানো হলেও কেউ ফিরতি কোনো যোগাযোগ করেনি।
প্রায় চার বছর অমীমাংসিত থাকার পর ২০২২ সালের জুনে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এবং পুলিশের মাধ্যমে গাজীপুরের মাওনায় একটি চার্চে তাকে সমাহিত করা হয়েছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন দক্ষিণখান থানার পুলিশ পরিদর্শক তদন্ত আজিজুল হক মিয়া।
তিনি বলেছেন, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের অনাপত্তিপত্র নিয়ে একজন দূতাবাস কর্মকর্তা, পুলিশ এবং মাজেদা খাতুনের উপস্থিতিতে বার্কারকে সমাহিত করা হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার মেয়ে অর্ধযুগের বেশি ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার দেবীপুর গ্রামের বাসিন্দা দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেছিলেন ওই দেশের নাগরিক থিইসিয়া সিকেওয়েস্ট।
মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান নামে ওই ব্যক্তি স্ত্রীকে নিয়ে ২০১৫ সালের শেষদিকে বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু কয়েক মাস পর ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয় থিইসিয়ার। তার স্বামীকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয় তখন।
কুমিল্লা সদর হাসপাতালে তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছিল, তাতে থিইসিয়ার শরীরে কীটনাশকের উপস্থিতি পেয়েছিলেন চিকিৎসকেরা।
চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা শুভ রঞ্জন চাকমা বিবিসিকে বলেছেন, ওই মামলায় পুলিশ মোহাম্মদ হাসানুজ্জামানের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছিল।
কিন্তু এ বছরের জুলাই মাসে হাসানুজ্জামান মারা যান বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা শুভ রঞ্জন চাকমা।
এদিকে, সেই ২০১৬ সাল থেকে লাশটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের হিমাগারে পড়ে আছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গের ইনচার্জ মোহাম্মদ সেকান্দার আলী।
কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওই সময় মর্গের ব্যবস্থা ছিল না, সেজন্য দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক এই নারীর লাশ এখানে পাঠানো হয়।
তিনি বলেছেন, থিইসিয়ার লাশ নিতে কেউ আসেনি, তার বাংলাদেশী স্বামী কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা স্বজন-কেউই আসেনি তাকে নিতে।
বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাস নেই, থিইসিয়ার নিজের দেশ থেকেও যে কোনো সন্ধান-প্রত্যাশী আসেনি তার খোঁজে, তার এটি একটি কারণ হতে পারে।
ধর্ম পরিচয় আর দুই স্ত্রীর দ্বন্দ্বে আট বছরের বেশি সময় ধরে মর্গে
মৃত্যুর পর আট বছরের বেশি সময় ধরে খোকন ওরফে খোকন নন্দী ওরফে খোকন চৌধুরীর লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের পড়ে আছে।
কোন ধর্মমতে তাকে সমাহিত করা হবে এ দ্বন্দ্বে তার দু’জন স্ত্রী, যাদের একজন হিন্দু এবং একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী, তারা আদালতের দ্বারস্থ হন। কিন্তু সে মামলাটি এখনো মীমাংসা হয়নি।
লাশ হস্তান্তর নিয়ে জটিলতায় খোকন কোন ধর্মের ছিলেন ছিলেন তা জানতে আদালতে মামলা হয়।
খোকনের স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক হাবিবা আকতার খানম বিবিসিকে বলেছেন, ২০১৮ সালে এই মামলার রায়ের তারিখ নির্দিষ্ট হয়েছিল। কিন্তু এর পর চারবার পিছিয়েছে সেই তারিখ।
তিনি জানিয়েছেন, ১৯৮০ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন খোকন নন্দী, এরপর ১৯৮৪ সালে তাদের বিয়ে হয়।
বিয়ের ৩০ বছর পর ২০১৪ সালের ২৬ জুন বারডেম হাসপাতালে মারা যান খোকন।
এরপরই কোন ধর্মমতে তার দাফন বা সৎকার হবে তা নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়, ফলে তখন তার লাশের ঠাঁই হয় বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে।
সেখান থেকে ওই বছরের নভেম্বরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয় খোকনের লাশ।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বলতে হাবিবা আকতার খানম কাঁদছিলেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমি খোকনের সম্পত্তি চাইনি কখনো, চাই না। আমি শুধু সম্মানের সাথে ইসলাম ধর্মমতে খোকনকে দাফনের অধিকার চাই।’
বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের মর্গে এমন বিরোধপূর্ণ জটিলতা কত লাশ আটকে আছে তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।
তবে কয়েক বছর আগে রংপুর মেডিক্যাল হাসপাতালের মর্গে এক নারীর লাশ চার বছর ধরে পড়ে থাকার খবর আলোচিত হয়েছিল।
২০১৪ লিপা রাণী থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে হোসনে আরা আত্মহত্যা করার পর থেকে রংপুর মেডিক্যাল হাসপাতালের হিমঘরে ছিল তার লাশ।
কোন ধর্মমতে তার লাশের সৎকার হবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল তার বাবা এবং শ্বশুর এই দুই পরিবারে।
দুই পরিবারের কেউই ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না।
শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালে মেয়েটির লাশ ইসলাম ধর্মমতে দাফনের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
লাশ সংরক্ষণে জটিলতা
অনেক সময়ই হাসপাতালের মর্গে দীর্ঘ সময় লাশ সংরক্ষণ বেশ কঠিন একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
কারণ দেশের বড় সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই হত্যা, আত্মহত্যা, বা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কারণে অনেক লাশ আসে ময়নাতদন্তের জন্য।
অনেক লাশ আসে যা ঘটনার সাথে সাথে শনাক্ত করা যায় না, পরিচয় নিশ্চিতের জন্য সেগুলো সংরক্ষণ করতে হয়।
এজন্য যে রকম সরঞ্জামাদি প্রয়োজন সরকারি হাসপাতালে তার ঘাটতি আছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের ইনচার্জ মোহাম্মদ সেকান্দার আলী বলেছেন, তার হাসপাতালে এখন লাশ সংরক্ষণের সুবিধা বেড়েছে। কিন্তু বছর খানেক আগেও হাসপাতালে মাত্র পাঁচটি ফ্রিজারে ২০টি লাশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল, যার মধ্যে তিনটি ফ্রিজার নষ্ট ছিল কয়েক বছর ধরে।
ওই তিনটি ফ্রিজার এখনো নষ্ট।
কিন্তু কয়েক মাস আগে ৪০টি লাশ সংরক্ষণ করা যায় এমন একটি বড় ফ্রিজার দেয়া হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে, তার ফলে এখন লাশ সংরক্ষণের সুযোগ বেড়েছে।
সেকান্দার আলী জানিয়েছেন, কোনো লাশ কতদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হবে তার নির্দিষ্ট নিয়ম নেই।
শনাক্ত করা যায়নি, এমন বেওয়ারিশ লাশ একটি নির্দিষ্ট সময় পরে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয়। কিন্তু আইনি জটিলতা আছে, এমন লাশের ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি ছাড়া সমাধির অনুমতি দেয়া হয় না।
সূত্র : বিবিসি