স্বদেশ ডেস্ক:
কারা প্রশাসনে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এর জেরে কেউ কেউ চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহিত নিচ্ছেন। আবার কাউকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
যাদের চাকরিচ্যুতির প্রক্রিয়া চলছে তাদের কেউ কেউ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর কারা অধিদপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিচ্ছেন। আবার কেউ স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার পর, চাকরি ফিরে পেতে মন্ত্রণালয়ে অবেদন করছেন। সেখানেও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তুলে ধরা হচ্ছে নানা অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, কারা অধিদপ্তরের ডিপ্লোমা নার্স ও ফার্মাসিস্ট পদে প্রতিবছর যত সংখ্যক লোক যোগ দিচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি চাকরি ছাড়ছেন। পদোন্নতি না পাওয়া এবং বদলিসহ নানা ক্ষেত্রে হয়রানির কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১ জুন চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার অবেদন করেন কারা অধিদপ্তরের সাঁটলিপিকার কাম-কম্পিউটার অপারেটর মোহাম্মদ মাসউদুল ইসলাম। সম্প্রতি ওই অবেদনটি প্রত্যাহারের জন্য তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের কাছে লিখিত দিয়েছেন। সেই অবেদনপত্রে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রিজন্স) কর্নেল আবরার হোসেনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে।
মাসউদুল ইসলাম বলেন, অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে চাকরি জীবনের ১৪ বছর অতিক্রম করেছি। কর্ম জীবনে কোনো নিয়মনীতি ভঙ্গ করিনি। ব্যক্তিগত নথি বা সার্ভিস বুকেও আমার বিরুদ্ধে কোনো বিরূপ মন্তব্য নেই। হঠাৎ অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক (প্রিজন্স) আমাকে নিজ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন। তিনি আমাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার নির্দেশ দেন। তার আদেশ না মানার কারণে তিনি আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখান। আমার ব্যক্তিগত নথি থেকে তথ্য গায়েবের চেষ্টা করা হয়। জুনিয়র সহকর্মীদের দিয়ে মানসিক নির্যাতন অব্যাহত থাকে। বিষয়টি আমি কারা মহাপরিদর্শককে অবহিত করেছি।
মাসউদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অমানবিক আচরণ ও মানসিক নির্যাতনের কারণে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। অসুস্থতা এবং মানসিক যন্ত্রণা থেকেই আমি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার অবেদন করেছিলাম। প্রকৃত অর্থে আমি চাকরি থেকে অব্যাহতি নিলে আমার সামাজিক মর্যদা ক্ষুণ্ন হবে। পাশাপাশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব বর্তমানে আমি বিষণ্নতায় ভুগছি। তাই চাকরি থেকে অব্যাহতিদানের অবেদনপত্রটি প্রত্যাহারের আর্জি জানিয়েছি।
এদিকে সহকারী প্রধান কারারক্ষী মোস্তাফিজুর রহমানকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে ২৬ জুন সুপারিশ করেন সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারের জেল সুপার শহিদুল ইসলাম। সেই সুপারিশের সঙ্গে একমত পোষণ করে ঢাকা বিভাগের ডিআইজি (প্রিজন্স) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম ৬ জুলাই শোকজ করেন মোস্তাফিজুর রহমানকে।
তদন্ত কর্মকর্তার সুপারিশে বলা হয়েছে, মোস্তাফিজুর রহমানকে নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে শরীয়তপুর জেলা কারাগারে যোগদানের জন্য গত বছরের ৭ মার্চ নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি শরীয়তপুর জেলা কারাগারে যোগদান না করে নিজের খেয়াল-খুশিমতো অতিবাস করতে থাকেন। তাকে যোগদানের জন্য শরীয়তপুর জেলা কারাগার থেকে নরসিংদী জেলা কারাগারের মাধ্যমে তাগিদপত্র দেওয়া হলেও তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।
নিজেকে অসুস্থ দাবি করলেও যথাযথভাবে বিষয়টি স্থানীয় কারা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেননি। ১ বছর ১ মাস ২১ দিন বিনা অনুমতিতে অতিবাস করার পর ১৯ মে শরীয়তপুর জেলা কারাগারে যোগদানের জন্য হাজির হন। তাই চরম দায়িত্বহীন ও স্বেচ্ছাচারী সহকারী প্রধান কারারক্ষীকে চাকরিচ্যুতির মতো কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। সাময়িক বরখাস্তকালীন তিনি যে বেতন-ভাতা বা আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন এর বেশি কিছুই পাবেন না মর্মে নোটিশ দেওয়া যেতে পারে।
সম্প্রতি বিভাগীয় মামলার উত্তরে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি আমাকে মুন্সীগঞ্জ জেলা কারাগারে বদলি করা হয়। আমি সেখানে যোগদানের প্রস্তুতি ও শান্তি বিনোদনের জন্য ১৫ দিনের ছুটিতে যাই। ছুটিতে থাকার সময় নরসিংদী জেলা কারাগারের মাধ্যমে জানতে পারি আমাকে মুন্সীগঞ্জ জেলা কারাগারের পরিবর্তে শরীয়তপুরে বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছে।
কোন অপরাধের কারণে এ আদেশ দেওয়া হলো তা আমার বোধগম্য নয়। তারপরও আমি শরীয়তপুর কাগারে যোগদানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এ সময় আমি ও আমার স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার স্ত্রীকে বারডেম, লায়ন্স চক্ষু হাসপাতাল, ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আমার স্ত্রীর দুই চোখ এখনো অন্ধ। এছাড়া ডায়াবেটিস ও কিডনি সমস্যায় ভুগছে।
আমার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, কোনো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। আমার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাই। এক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় করিনি। তাগিদপত্র গ্রহণ না করার অভিযোগটি ভিত্তিহীন। অসুস্থতা নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো সন্দেহ থাকলে মেডিকেল বোর্ড গঠনের সুযোগ আছে। আমার দেওয়া মেডিকেলসংক্রান্ত কাগজপত্র সঠিক কিনা তা-ও যাচাইয়ের সুযোগ আছে। এসব যাচাই না করে আমাকে সাময়িক বরখাস্ত করা এবং আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা সম্পূর্ণ অমানবিক।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল আবরার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, চাকরি থেকে মাসউদুল ইসলামের অব্যাহতির অবেদন নিয়ম অনুযায়ী গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি যেহেতু চাকরি ফিরে পেতে সচিব মহোদয়ের কাছে আবেদন করেছেন, তাই এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মাসউদুল আমার বিরুদ্ধে মনগড়া অভিযোগ তুলেছেন। তাকে শেষ বিচারে দাঁড়াতে হবে। ভয়ভীতি দেখানো, হুমকি দেওয়া এবং নির্যাতনতো দূরের কথা, আমি তাকে কখনো আমার রুমেই ডাকিনি।
একজন কর্নেলের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। মাসউদুল এর আগেও আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন। সেনা সদর দপ্তর নয় মাস ধরে অভিযোগের তদন্ত করেছে। কিন্তু অভিযোগের সত্যতা পায়নি। তিনি আরও বলেন, আমার ক্ষোভ থাকলে সাবেক আইজি-প্রিজন্সের প্রতি থাকতে পারে। মাসউদুলের প্রতি ক্ষোভের কোনো কারণ নেই।
এক প্রশ্নের উত্তরে কর্নেল আবরার হোসেন বলেন, কারা অধিদপ্তরের বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। বিধি মোতাবেকই সব হচ্ছে। কাউকে যদি অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে নিশ্চয় তার আপিল করার সুযোগ আছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কারাগারগুলোয় ডিপ্লোমা নার্স ও ফার্মাসিস্টের যেসব পদ শূন্য রয়েছে, সেগুলো পূরণের চেষ্টা করছি।