স্বদেশ ডেস্ক:
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন জোট সরকার জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাসংবলিত সাংবিধানিক ৩৭০ ধারা ও ৩৫ক অনুচ্ছেদ বাতিল করেছে। একই সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে দুই টুকরো করে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করেছে- একটি জম্মু-কাশ্মীর, অপরটি লাদাখ।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। অতিরিক্ত হাজার হাজার সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। গত সোমবার থেকে কারফিউ চলছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক-টুইটার অচল হয়ে পড়েছে। নেতা-নেত্রী, অধিকারকর্মীসহ ৫ শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে।
সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে খবর সংগ্রহ করতে পারছে না। কার্যত গোটা বিশ^ থেকে কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ক্ষোভে ফুঁসছে কাশ্মীরের জনগণ। যে কোনো সময় বিস্ফোরণ হতে পারে। তারা ভারতীয় সেনাদের ওপর পাথর ছুড়ছে; কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নামছে; বেশ কয়েক স্থানে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। বিজেপি সরকারের এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার পর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে একটি প্রশ্ন জোরালো হয়েছে। সেটি হলো-
ভারতের গণতন্ত্র কি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে? যে ভারতকে বিশ্বের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হতো, সেই গণতন্ত্রের মুখ আজ মøান। ব্রিটিশ গণমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছে, কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তা ও নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাগাজিন দি আটলান্টিক আরও একধাপ এগিয়ে বলেছে- ভারত যেভাবে কাশ্মীরিদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে এতে দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্রই হুমকির মুখে পড়বে। এর ব্যাখ্যা গিয়ে পত্রিকাটি বলেছেÑ সংজ্ঞা অনুযায়ী গণতন্ত্রের বাস্তবতা হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠরাই শাসন করবে।
কিন্তু সত্যিকারে বিষয়টি কি তা-ই? প্রকৃত গণতন্ত্র হলো একটি আদর্শিক কাঠামো, যেখানে সর্বধর্ম, বর্ণ ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগণের অধিকার সংরক্ষণ করা হবে। অর্থাৎ গণতন্ত্র হলো সেই প্রক্রিয়া, যেখানে প্রান্তিক অধিবাসীর অধিকারও রক্ষা করা হবে। মূলত ভারতের এই বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকিয়েই তো ১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের একাংশের জনগণ ভারতের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।
সেই সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে ভারতের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। এ কারণে জম্মু-কাশ্মীরকে পৃথক সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়া হয়। জম্মু-কাশ্মীরের ছিল পৃথক পতাকা, আলাদা সংবিধান। এমনকি পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া সব বিষয়ে কাশ্মীরের রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছিল। বিশেষ মর্যাদার মধ্যে আরেকটি বিষয় ছিল যে, কোনো ভারতীয় চাইলেই কাশ্মীরে বসতি স্থাপন করতে পারবে না।
কিন্তু মোদি সরকার তড়িঘড়ি করে বিল পাস করিয়ে কাশ্মীরিদের এসব অধিকার কেড়ে নিল। আর সে জন্য আফসোস করতে শোনা গেল কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিকে। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তাদের ঐতিহাসিক ভুল।
এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক কোন দিকে যাচ্ছে? বিল পাসের পর পরই পাকিস্তান কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। শুধু প্রতিক্রিয়ায়ই থেমে নেই ইসলামাবাদ, তারা পদক্ষেপও নিয়েছে। ইতোমধ্যে কূটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বন্ধ করেছে এবং দুই দেশের মধ্যে যে সমঝোতা এক্সপ্রেস চলাচল করত, সেই ট্রেনও বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর পাকিস্তানকে এসব সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, ভারত কাশ্মীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টালে তারাও তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে। অর্থাৎ পারমাণবিক ক্ষমতাধর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছে। এ পরিস্থিতি গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।
শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণলয় জানিয়েছে, পাকিস্তান যেন কাশ্মীরের বাস্তবতা মেনে নেয়। কিন্তু একই সঙ্গে সে খোঁচাও দিয়েছে যে, পাকিস্তান তো আসলে নার্ভাস হয়ে গেছেÑ কাশ্মীরের (ভারত নিয়ন্ত্রিত) জনগণ যদি উন্নত জীবন পেয়ে যায় তা হলে তাদের ভুল বোঝানো কঠিন হবে। দুই পক্ষের এমন টানাটানিতে জাতিসংঘ তেমন জোরালো কোনো ভূমিকা নিচ্ছে না। আন্তেনিও গুতেরেস দুই পক্ষকেই সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে বলেছেন; একই সঙ্গে সিমলা চুক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়ে সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন যে, তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি ছাড়াই দুই পক্ষ চাইলে এ বিষয়ে সমঝোতার আসার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই অবস্থানে ভারত কখনই আসতে চায়নি। দিল্লি সব সময় কাশ্মীর ইস্যুতে নিজেদের অভ্যন্তরীণ ইস্যু হিসেবে বলে এসেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে অন্য যে কোনো ব্যাপারে আলোচনায় রাজি হলেও সেখানে কাশ্মীর ইস্যু থাকলেই দিল্লি পিছিয়ে এসেছে। আর পাকিস্তানে একে সব সময় আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে দেখানোার চেষ্টা করেছে।
এদিকে কাশ্মীর পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই। শুক্রবার জুমার নামাজের জন্য চলমান কারফিউ কিছুটা শিথিল করলেও লোকজনকে সতর্ক করে দেওয়া হয়, তারা যেন মসজিদের বাইরে অন্য কোথাও সমবেত না হয়। এ ছাড়া কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের প্রধান মসজিদ খুলেই দেওয়া হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ঈদুল আজহা উপলক্ষে সাধারণের চলাচল কিছুটা সহজ করে দিতে পারে। কিন্তু এর পর? এর পর কি আবারও সেই কারফিউ? সংশ্লিষ্টদের ধারণা সেটিই। বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার চাইছে যে কোনো মূল্যে কাশ্মীরে তাদের মিশন সম্পন্ন করতে। এ জন্য যত কঠোর হওয়া প্রয়োজন, তা-ই করবে। তবে মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরে সেটা কতটা সম্ভব, সেটি বড় প্রশ্ন। আর বিজেপি যদি শুধু শক্তি প্রয়োগ করে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে চায়, সেটিও হবে ভুল। সে ক্ষেত্রে কাশ্মীর হাতে এলেও কাশ্মীরিদের মন পাওয়া যাবে না।