আমরা অবাক হই যে, কুরআনে ৮০ বারের বেশি জাকাতের কথা বলা হয়েছে। একমাত্র নামাজ বা সালাত ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে এত বেশি উল্লেখ নেই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সালাত ও জাকাতের ব্যাপারে এত বেশি উল্লেখ রয়েছে কেন? এ দু’টিরই কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি।
প্রথমত, জাকাতের কথা। আমাদের মনে হয়, জাকাত হচ্ছে ইসলামী অর্থনীতির প্রধান দিক। ইসলাম বিশ্বাস করে, জাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। ফি-সাবিলিল্লাহর খাতে সব ভালো কাজ করাই সম্ভব, ঋণগ্রস্তদের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আমরা জানি, সারা বিশ্বে দারিদ্র্য একটি বড় সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান পুঁজিবাদ প্রদান করতে পারেনি। পুঁজিবাদের দেশ দরিদ্রে ভরা। একমাত্র ইসলামের খেলাফতের সোনালি সময় ছাড়া কেউ দারিদ্র্য পুরোপুরি দূর করতে পারেননি। উমাইয়া ও আব্বাসি খেলাফতের সময়েও দারিদ্র্য ছিল না। এর কারণ- জাকাত সবাই আদায় করতেন, সরকার না করলেও। এমন অর্থশালী লোক ছিলেন না যিনি জাকাত দিতেন না।
সুতরাং আমাদের জাকাত নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ, জাকাত মুসলিম বিশ্বের দারিদ্র্য দূর করতে পারে। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ধনী লোক জাকাত দেন না। যারা দেন, তারাও হিসাব করে দেন না। সবাই যদি হিসাব করে জাকাত দিতেন, তাহলে বাংলাদেশের মতো মুসলিম অধ্যুষিত দেশে দারিদ্র্য থাকত না। বিশ্বখ্যাত মনীষী ড. ইউসুফ আল কারযাভীর মতে, অমুসলিম ফকির-মিসকিনদেরকেও জাকাত দেয়া যায় (দ্রষ্টব্য : ইসলামে জাকাতের বিধান)।
এখন বাংলাদেশে একটি জাকাত আন্দোলন দরকার। সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট (সিজেএম) ভালো কাজ করছে। এ রকম আরো অনেক সংগঠন দাঁড়াতে হবে, যারা সব ধনীর জাকাত আদায় করবে। আল্লাহ তায়ালা ৮০ বারের বেশি সময় জাকাত দিতে বলেছেন। আমরা যদি যথাযথভাবে জাকাত আদায় করতে পারি, তা হলে কেবল আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্য পূরণ হবে।
এখন সালাতের কথা বলব। কুরআনে ৮০-৯০ বারের বেশি সালাতের কথা বলা হয়েছে, এখন তা উল্লেখ করছি। আমার মনে হয়, মানুষের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা আনুগত্যের প্রবণতা রেখে দিয়েছেন। সুতরাং সঠিক আনুগত্যের কথা যদি না বলা হয়, তাহলে মানুষ শিরক এবং দেবদেবীর পূজা করবে; মানুষের পূজা করবে। এটা যেন কিছুতেই না হতে পারে, এ জন্য আল্লাহ তায়ালা বারবার নামাজের কথা বলেছেন। সঠিক আনুগত্য কী, তা মানুষ বুঝতে পারলে ভুল ইবাদতের পথে আর যাবে না।
এখন ইসলামী অর্থনীতির তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে বলব। এটি হচ্ছে, সুদ নিষিদ্ধ হওয়া। আল্লাহ তায়ালার নজরে এটি ভয়াবহ অপরাধ। অন্য কোনো অপরাধের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যুদ্ধের কথা ঘোষণা করা হয় না। কিন্তু সুদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের সূরা বাকারায় যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। সুদ নেয়া কত বড় অন্যায়, এ থেকে বোঝা যায়। সুদের কারণে একশ্রেণীর হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে যায় এবং বেশির ভাগ মানুষই শোষিত ও দরিদ্রে পরিণত হয়। যেকোনো কারণেই হোক, সুদের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণ যেমন বুঝতে পারছে না, তেমনি শিল্পপতিরাও বুঝতে পারছেন না।
আল্লাহ তায়ালা যেটাকে এত ভয়ঙ্কর মনে করছেন, এটা শিল্পপতিরা এবং পলিসিমেকাররা বুঝতে পারছেন না। তাদের ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে আরো পড়তে ও জানতে হবে। বিশেষ করে ড. উমর ছাপরার বইগুলো। সৌভাগ্যবশত বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন হচ্ছে। আশা করা যায়, এ আন্দোলন আরো এগিয়ে যাবে। অনুরোধ করব, সব দেশের শিল্পপতিরাই যেন মুদারাবা (একপক্ষের অর্থ দিয়ে একপক্ষের পরিশ্রম এবং লাভ-লোকসান ভাগাভাগি করা), মুশারাকা (বিভিন্ন পক্ষের অর্থ দিয়ে শরিকানা ব্যবসা করা এবং লাভ-লোকসান ভাগ করে নেয়া), বাই মুয়াজ্জাল (পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় বৈধ হওয়া এবং সেই ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে লাভ করা) ইত্যাদি পদ্ধতি গ্রহণ করেন।
ইসলামী অর্থনীতির অন্যান্য দিক হচ্ছে- সর্ব ক্ষেত্রে ইনসাফ বা সুবিচার, অর্থনীতির ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ভাইয়ের মর্যাদা এবং পর্যাপ্ত মজুরি দেয়া, কোনোভাবেই শোষণ না করা। এ ছাড়া ইসলামে মজুদদারি ও অতিরিক্ত মুনাফা নেয়া অবৈধ। ইসলামের অন্য একটি নীতি হচ্ছে- সরকার বা সরকারি সংস্থা বাজারের ওপর নজরদারি করবে সুবিচারের স্বার্থে। আরেকটি নীতি হচ্ছে- সম্পদ যেন কেবল ধনীদের হাতে পুঞ্জীভূত না হয়, যেমনটা সূরা হাশরে বলা হয়েছে। সংক্ষেপে ইসলামী অর্থনীতির মূল নীতিগুলো তুলে ধরা হলো। বিশেষ করে জাকাতের বিরাট গুরুত্বের কথা উল্লেখ করলাম।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার