শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৬ পূর্বাহ্ন

তরল দুধে ফিরছে আস্থা

স্বদেশ ডেস্ক:

বাজার চলতি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের তরল দুধ নিয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠানের করা গবেষণায় নেতিবাচক ফল উঠে আসা; এর জেরে এ নিয়ে সর্বত্র ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার কারণে অতিপ্রয়োজনীয় এ খাদ্যপণ্যটির ওপর আস্থা হারিয়েছিলেন ভোক্তারা। তবে আশার কথা- ফের তরল দুধের ওপর ফিরে আসছে তাদের আস্থা। খুচরা দোকানগুলোর অধিকাংশই বেশ কিছু দিন তরল দুধ বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঈদ সামনে রেখে তারা ফের দুধ বিক্রি শুরু করেছেন। খামারিরাও বলছেন- এ খাতে মাঝে যে দশা ছিল, সেটি কাটিয়ে এখন গতি ফিরে আসছে।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, সম্প্রতি ডেইরি ফার্ম খাতে ব্যাপক ধস নেমেছিল। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নলালিত ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পে হাজার হাজার ছোট খামারি রয়েছেন, যা তাদের স্বাবলম্বী করেছে। তাদের অনেকে এ ক্রান্তিকালে দুধ বেচতে না পেরে অনন্যোপায় হয়ে গরু বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি যোগ করেন, সরকার নানামুখী উদ্যোগ নেওয়ায় অতিসম্প্রতি ব্যবসায় ফের গতি আসছে। এখন সরকারের তরফে কি করা দরকার? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, খামারিদের বিনাসুদে ঋণ না দিলে দুগ্ধশিল্প মার খাবে। এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা পথে বসবেন। ঈদের পর তরল দুধের সংকট হতে পারে, শঙ্কা প্রকাশ করেন ইমরান হোসেন।

রাজধানীর হাতিরঝিলসংলগ্ন নিউ বি-বাড়িয়া বেকারিতে তরল দুধ কিনতে এসেছেন শিক্ষক আবু জাহান। তরল দুধ ক্ষতিকর বলে শোনা গেছেÑ তবু কেন কিনছেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মাঝে কিছু দিন কেনা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এখন জানতে পেরেছি, বিদেশ থেকেও পরীক্ষা করে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি তরল দুধে। তাই কেনা শুরু করেছি। বিক্রেতা মো. জাহাঙ্গীর আলমও বলেন, ক্রেতারা এখন আবার তরল দুধ খুঁজছে। আমরা অল্প হলেও দুধ সংগ্রহে রাখছি।

এদিকে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক বা ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয় বলে জানিয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল। একই বক্তব্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলেরও (বিএআরসি)।

গবেষকদের দাবি, অঞ্চল ও পরিবেশভেদে এবং গবাদিপশুর খাদ্যাভ্যাসের ওপর নির্ভর করে দুধে কী পরিমাণ জীবাণুর উপস্থিতি থাকবে। তবে অ্যান্টিবায়োটিক কিংবা বিভিন্ন ধাতুর উপস্থিতির একটি নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে। নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ থাকলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বলা যাবে।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়, দেশে উৎপাদিত তরল দুধের গুণগত মানের ওপর সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন, এতে ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি ও দুধের দাম পড়ে যাওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক ও দুগ্ধশিল্পের জন্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।

বিএআরসি জানায়, যে আটটি দুধের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা করে পরীক্ষা করানো হয়েছে। এসব নমুনা ভারতের চেন্নাইয়ে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি ‘এসজিএস’ কর্তৃক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। তাদের ফল পাওয়া ও বিএআরসির ফল একই। পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত যে আটটি দুধ নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে, তাতে মানুষের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি। বাকি যে ছোট-বড় দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি রয়েছে, তাদের দুধের তেমন ক্ষতিকর কিছু নাও থাকতে পারে। তবে পর্যায়ক্রমে সব দুধের নমুনা পরীক্ষা করা হবে।

কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক আমাদের সময়কে জানান, পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা আমাদের চ্যালেঞ্জ। সহজলভ্য পুষ্টির খাদ্য দুধ। সরকারের সদিচ্ছা ও বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে আজ দেশে দুধের উৎপাদন অনেক বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুধের মধ্যে ভারী ক্ষতিকর ধাতুর অস্তিতের যে খবর সব জায়গায় ছেয়ে গেছে, তা সম্পূর্ণ সত্য নয়। যারা এ তথ্য প্রকাশ করেছে, তাদের গবেষণার সে সক্ষমতা নেই। তাই দুধের ব্যাপারে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

ড. রাজ্জাক বলেন, বিগত বছরগুলোতে ফল সবজি, মাছসহ খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন প্রয়োগ করা হয় বলে ব্যাপকভাবে প্রচার চলেছে। ফলে মানুষের মধ্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে আর্থিক ক্ষতিসহ বৈদেশিক বাজারে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে এবং হচ্ছে। এবার তরল দুধ আলোচনায় আনা হয়েছে। পরীক্ষাগারে এসব দুধ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোনো দুধেই কোনো প্রকার ভারী ধাতু যেমন লিড ও ক্রোমিয়ামের রেসিডিউ/অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়নি। কোনাে প্রকার সালফা ড্রাগের রেসিডিউ/অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়নি। শুধু একটি নমুনায় ঈযষড়ৎধসঢ়যববহরপড়ষ-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে প্রতিকেজিতে শূন্য দশমিক শূন্য ৬ মাইক্রোগ্রাম। কারও কারও মতে, শূন্য দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। গবেষণালব্ধ ফল বিশ্লেষণে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, দেশীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উৎপাদিত বাজারজাতকৃত দুধপানে কোনো প্রকার স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই।

মন্ত্রী বলেন, বিএআরসি হচ্ছে, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এপেক্স বডি। খাদ্যসহ যে কোনো প্রকার আতঙ্ক বা বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য বিভিন্ন পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে শিগগির দেশে এক্রিডেটেড ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু পালন অনুষদের ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষকের দাবি, দুধে সহনীয় মাত্রা ব্যাকটেরিয়া থাকলে তা পান করা যাবে। গবেষক দলের প্রধান বিএসটিআইয়ের মান কমিটির চেয়ারম্যান (দুধ শাখা) ও বিশ্ববিদ্য্যালয়ের ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ডেইরি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. নূরুল ইসলাম বলেন, পাস্তুরিত প্রতি এমএল দুধে মোট ২০ হাজার পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়া থাকলে তা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। এর মধ্যে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া সর্বোচ্চ ১০টা থাকলে এই দুধ পানে কোনো সমস্যা থাকবে না। গবেষকদের দাবিÑ দুধে স্বভাবতই কিছু ব্যাকটেরিয়া বা নানা কারণে ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি থাকতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক মানদ- ও সহনীয় মাত্রার বেশি না হলে তা মানবদেহের ক্ষতির কারণ হবে না। তারা বলেন, কাঁচাতরল দুধে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকা খুবই স্বাভাবিক। পাস্তুরায়নের মূল উদ্দেশ্য হলোÑ প্যাথোজেনিক (রোগ সৃষ্টিকারী) ব্যাকটেরিয়া সম্পূর্ণভাবে মেরে ফেলা। গবেষকদের দেখা উচিতÑ প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া পাস্তুরিত দুধে আছে কিনা? তবে পাস্তুরিত দুধে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেশি হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। এর প্রথম ও প্রধান কারণ হলোÑ গুদামে কিংবা দোকানে কোল্ড চেইন বজায় না রাখা। চেইন ঠিক না থাকলে ব্যাকটেরিয়া বংশ বিস্তার করে; ফলে দুধে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং পরীক্ষার সময় মাথায় রাখতে হবেÑ মূল সমস্যাটি দুধে না প্রক্রিয়াজাতকরণে? পাশাপাশি বিপণন ব্যবস্থাও হতে হবে বিজ্ঞানসম্মত।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে প্রায় ৯৯ লাখ টন তরল দুধ উৎপাদন হয় সারাদেশে। যার মাত্র ১০-১৫ শতাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে প্যাকেটজাত হয়ে বাজারে আসে। বাকিটা বিক্রি হয় খোলাবাজারে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877