রবিবার, ২৬ মে ২০২৪, ১২:১৪ পূর্বাহ্ন

মা দিবস : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

মা দিবস : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম:

প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ‘আন্তর্জাতিক মা দিবস’ পালিত হয়। দিবসটি উপলক্ষে কীর্তিমান মায়েদের সংবর্ধনা দেয়া হয়। পত্রপত্রিকায় ফলাও করে তাদের ছবি প্রকাশিত হয়। কার্ড, খাবার, উপহার পাঠিয়ে আমরা দিবসটি উদযাপন করি। আন্তর্জাতিক বা জাতীয়পর্যায়ে যতগুলো দিবস পালিত হয়ে থাকে, তার অধিকাংশই বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে রূপান্তরিত হয়। মা দিবস এর ব্যতিক্রম নয়। মা ও সন্তানের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সম্পর্ককে ছাপিয়ে বাণিজ্যিক উপাদান ও তার প্রকাশই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন রকমের কার্ড, উপহারসামগ্রী ও ফুলের ব্যবসা বেশ জমজমাট। ব্যবসায়িক স্বার্থে মূলত এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

মায়ের তুলনা কিছুতেই হয় না। মা সে তো মা। সন্তান গর্ভে ধারণ করা থেকে শুরু করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত মা সন্তানকে আগলে রাখেন। তার সব চিন্তাচেতনায় সন্তানের কল্যাণই প্রাধান্য পায়। মায়েদের সারা জীবনের কল্যাণ কামনাকে শুধু এক দিনের মাপকাঠিতে বিচার করা কতটুকু যৌক্তিক, কতটুকু মানবিক এটা অবশ্যই চিন্তার দাবি রাখে।

এনা জারভিস তার মায়ের প্রতি সম্মান দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। সন্তান হিসেবে প্রতিটি সন্তানের দায়িত্ব, তার পিতা-মাতাকে যথাযথ সম্মান দেখানো; তাদের সমাজে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা। এনা জারভিস তার মায়ের স্বীকৃতি আদায় করার জন্য ১৯১৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন; আমেরিকার রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন এক ফরমানে মার্কিন সিনেটে মা দিবসের স্বীকৃতি দেন। তখন থেকেই মা দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রথম দিকে আমেরিকার কয়েকটি রাজ্যে পালিত হলেও এখন বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মা দিবস পালিত হচ্ছে। মা দিবসে মাকে শ্রদ্ধা, অভিনন্দন কিংবা উপহারসামগ্রী পাঠানোর বিরোধিতা কেউ করেনি। আমিও করি না। এক দিনের জন্য মা দিবস পালনের ভেতর দিয়ে মূলত মাকে, মায়ের ভ‚মিকাকে সীমিত করা হচ্ছে বলে আমার মনে হয়।

এক দিকে আমরা কীর্তিমান মায়েদের সংবর্ধনা দিচ্ছি। অপর দিকে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে কুণ্ঠাবোধ করছি না। অথচ আমি জিতলে জিতে যায় মা। এক দিনের জন্য মাকে ভালোবাসার অর্থ হলো, মায়ের সম্মান ও মর্যাদাকে খাটো করা। এতে মা দিবসের মর্যাদা রক্ষিত হয় না। যে মা আমাকে গর্ভে ধারণ করলেন, লালন করলেন, রাতে না ঘুমিয়ে বুকের উত্তাপ দিয়ে আমাকে আগলিয়ে রাখলেন সে মাকে কী করে আমরা একটি নির্দিষ্ট দিনে সীমাবদ্ধ করে রাখি?

আমরা এনা জারভিসের দেখানো পথে হাঁটছি। কিন্তু আমাদের আদর্শিক অবস্থান কী? এক ব্যক্তি তার মাকে কাঁধে করে ইয়েমেন থেকে এনে হজ করানোর শেষে রাসূলে করিম সা:কে-জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি কি আমার মায়ের কোনো ঋণ শোধ করতে পেরেছি? জবাবে রাসূলে করিম সা: বলেছিলেন, মা তোমাকে প্রসব করার সময় যে প্রসব বেদনা সহ্য করেছেন তার একটি ঢেউও শোধ করতে পারনি।

রাসূলে কারিম সা: কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সন্তান হিসেবে দেখভালের দায়িত্ব কার প্রতি বেশি? তিনি বলেছিলেন, তোমার মা। সে সাহাবি পরপর তিনবার একই কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। রাসূলে কারিম সা: একই জবাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তোমার মা। চতুর্থবারে বলেছেন তোমার পিতা। মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক নিয়ে কুরআনে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং বাবা-মায়ের সাথে উত্তম ব্যবহার করো’ (সূরা বনি ইসরাইল-আয়াত ২৩)। আল্লাহ তায়ালা একই সূরার আরেক আয়াতে কারিমায় নির্দেশ দিয়েছেনÑ ‘তাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে, তাদের উহ্ শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিও না এবং তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলো’ (সূরা বনি ইসরাইল-আয়াত ২৩)। তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলো, ‘হে আমার পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৪)।

কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনে কিংবা বছরে এক দিন সম্মান প্রদর্শন করলেই মায়ের প্রতি দায়িত্ব¡ শেষ হয়ে যায় না। আমরা সে দায়িত্ব কতটুকু পালন করছি? ইসলাম ধর্মের কথা না-ই বললাম। হিন্দু ধর্মেও রয়েছে, জননী জন্মভ‚মিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী অর্থাৎ জননী এবং জন্মভ‚মি স্বর্গের চাইতেও পবিত্র।’ অথচ আমরা নির্দিষ্ট দিনে এই পবিত্রতার কথা মনে করি। বাকি ৩৬৪ দিনের কথা বেমালুম ভুলে যাই। এই শিক্ষা কোনো ধর্মবিশ্বাস দেয়নি। আরেকটি ব্যাপার খুবই বেমানান মনে হয়। কীর্তিমান মাদেরকে সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছে; কিন্তু কৃতী মা কারা? যে মা সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে সন্তানকে মানুষ করেছেন তিনি, নাকি যিনি চাতালে শ্রমিকের কাছ করে সন্তানকে ডাক্তার বানিয়েছেন। এদের খবর আমরা ক’জন রাখি? এদের কোনো সংবর্ধনা দিতে দেখা যায় না। মা দিবসের নামে এটা কি মায়েদের সাথে একধরনের প্রতারণা নয়? আমি আশা করি, সবাই ব্যাপারটাকে অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সাথে মানবিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করবেন।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877