বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৩ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ‘মেডিক্যাল সিন্ডিকেট’

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ‘মেডিক্যাল সিন্ডিকেট’

স্বদেশ ডেস্ক: মালয়েশিয়ার স্থগিত শ্রমবাজার কবে খুলছে তা নিয়ে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যেই চলছে জল্পনা-কল্পনা। যেকোনো সময় বাজার খুলে যাচ্ছে। এমন কথা বেশ কিছু দিন ধরে ‘চাওর’ হলেও বাস্তবে সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারটি প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে। মালয়েশিয়ার নাজিব রাজ্জাক সরকারের পতনের পর মাহাথির মোহাম্মদ দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই ঘোষণা দেন, কোনো ধরনের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তার দেশে বিদেশী কর্মী আমদানি করা হবে না। শুধু তা-ই নয়, অবশ্যই অল্প অভিবাসন (কম খরচে) ব্যয়ে কর্মী আসতে হবে বলেও শ্রমিক প্রেরণকারী দেশগুলোর প্রতি তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন।

তার দেয়া নির্দেশনার পরই মালয়েশিয়া সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত কমিটির সাথে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের (জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ) একাধিক যৌথ সভা বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ গত ২৯-৩০ জুন মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে (অনলাইন) এবার কর্মী প্রেরণ করা হবে, বেতনভাতা নির্ধারণ, শ্রম আইন অনুযায়ী থাকা খাওয়াসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা যাতে উভয় দেশ নিশ্চিত হতে পারে সেসব বিষয় নিয়েই মূলত বৈঠক হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আগেই এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। এই মুহূর্তে এমওইউ (মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ড) ঘষামাজার চূড়ান্ত কাজ চলছে। এটি শেষ হলে প্রস্তাবটি পাঠানো হবে মালয়েশিয়ার কেবিনেটে। কেবিনেট থেকে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন হলেই আসতে পারে স্থগিত শ্রমবাজার উম্মুক্তের কাক্সিক্ষত ঘোষণা।
তবে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সূত্রগুলো গতকাল কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, দিনক্ষণ দিয়ে তো আর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলবে না। কর্মী আমদানিতে তারা আগে তাদের চাহিদাটা দেখবে। তবে এর জন্য তো প্রক্রিয়া আছে। প্রক্রিয়াগুলো চূড়ান্ত হলেই কেবল শ্রমবাজার খোলার ঘোষণা আসতে পারে। আর এটি এখন এমন পর্যায়ে রয়েছে ঘোষণাটা যেকোনো সময় হতে পারে। এ নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে? বরং আরা দেখছি মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশের মিডিয়াতে বেশি নেতিবাচক প্রতিবেদন আসছে। এটার কারণে-ই মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে এখন দ্বিধাবিভক্তি কাজ করছে বলেও ওই কূটনৈতিক সূত্রগুলো নয়া দিগন্তের কাছে দাবি করেছেন।

এ দিকে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের আমলে বাংলাদেশ থেকে কলিং ভিসায় যে পরিমাণ শ্রমিক গেছে, তার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সে দেশের নাগরিক দাতো শ্রী আমিন নুর। তার নেতৃত্বে ঢাকার ১০ রিক্রুটিং এজেন্সি নিয়ে গঠিত হয়েছিল শক্তিশালী কর্মী পাঠানোর সিন্ডিকেট। অভিযোগ উঠছে, এবারো ওই সিন্ডিকেটের মধ্য থেকেই একাধিক এজেন্সি মালিক আবারো মালয়েশিয়ার চিহ্নিহ্নহ্নহ্নত ব্যবসায়ীদের নিয়ে নানা কৌশলে ‘মেডিক্যাল সিন্ডিকেট’ করতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। ইতোমধ্যে ঢাকা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দুবাইতে সিন্ডিকেটের সদস্যদের একাধিক বৈঠক হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বিষয়টি জানার পর তাদের গতিবিধি শনাক্ত করতে মাঠে মেনেছে বলেও সূত্রে জানা গেছে। দাতো আমিন নুরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মালয়েশিয়ায় পরিচিত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী দাতো হানিফের নেতৃত্বেও মেডিক্যাল সেন্টার নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ রয়েছে। যদিও ওই চিহ্নহ্নিত রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা মালয়েশিয়ার কলিং ভিসার কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই দাতো হানিফকে দিয়ে সিন্ডিকেট করানোর পরিকল্পনা এঁটেছিলেন। পরে দাতো হানিফ ছিটকে পড়লে টিকে যায় দাতো শ্রী আমিন নুর। এই দুই সিন্ডিকেটের বাইরেও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে আরো দু’টি সফটওয়্যার কোম্পানি এবার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে আধিপত্য ধরে রাখতে (ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে) তাদের অনলাইন সিস্টেমও দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে সূত্রটি জানিয়েছে, মাহাথির মোহাম্মদের ‘নো সিন্ডিকেট’ এমন ঘোষণার পর ঢাকা ও মালয়েশিয়ার সক্রিয় সিন্ডিকেটের সদস্যরা শ্রমিক পাঠানোর জন্য কলিং ভিসার সিন্ডিকেট বাদ দিয়ে প্রভাবশালীদের সম্বন্বয়ে ১৫-১৬টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ে ‘মেডিক্যাল সিন্ডিকেট’ করতে ভেতরে ভেতরে অপতৎপরতা শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে ওই সদস্যরা দুই দেশের প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করতে হাই প্রোফাইল লবিং করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

যদিও গত ২৮ জুন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী তুন কুলাসেগারেনের কাছে পাঠানো প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিদেশগামী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ঢাকার যেসব মেডিক্যাল সেন্টার থেকে করানো হবে সেগুলো যাতে মালয়েশিয়া সরকারের মনোনীত স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ফোমিমার (এফওএমইএমএ) মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয় সেটি নিশ্চিত করার জন্য তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন।

এর আগে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ঢাকায় এবং মালয়েশিয়ার বিভিন্ন সভায় সংবাদমাধ্যমকে প্রশ্নের উত্তরে জোর দিয়ে বলেছেন, ‘মালয়েশিয়ায় এবার কোনো ধরনের সিন্ডিকেশন হতে দেবো না। তারা যত বড়ই প্রভাবশালী হোক না কেন।’

গতকাল মালয়েশিয়া র মানবসম্পদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে এবার কোনো সিন্ডিকেটের হাত থাকবে না। এটাই হলো চূড়ান্ত কথা। এখন কেউ যদি বাজারে আজগুবি কথা বলে বেড়ায় সেটি সময়ই বলে দিবে শ্রমবাজারে আদৌ কোনো সিন্ডিকেট আছে কি না? এক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুুক্তে মালয়েশিয়ায় কোনো ধরনের সমস্যা নেই। যত সমস্যা এখন বাংলাদেশে। সেখানেই বেশি কাদা ছোড়াছুড়ি হচ্ছে। এ কারণেই এই মার্কেট খুলতে বিলম্ব হচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।

উল্লেখ্য ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মালয়েশিয়া সরকার দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বাংলাদেশ থেকে কর্র্মী আমদানির ওপর স্থগিতাদেশ দেয়। এর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত ১১ মাস কেটে গেছে। এর আগে ঢাকার ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির নামে দেশটিতে প্রায় পৌনে তিন লাখ কর্মী পাড়ি জমায়। আর এসব কর্মী প্রেরণের সাথে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির কাছ থেকে নাজিব রাজাকের ছায়া পাওয়া বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত দাতো আমিন দেশ থেকে যাওয়া প্রতি কর্মীর নামে ‘আন্ডার টেবিলে’ পাঁচ হাজার রিংগিত (প্রায় এক লাখ ১০ হাজার) করে আদায় করেছেন। আর এই টাকার ভাগবাটোয়ার একটি অংশ মালয়েশিয়ায় জাতীয় নির্বাচনে হেরে পতন হওয়া নাজিব রাজাক ও তার স্ত্রীর নামে যেত বলে দেশটির পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। এরপরই মালয়েশিয়া সরকার শ্রমিক পাঠানোর ঘটনার সাথে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে সে রহস্য উদঘাটনে অনুসন্ধান শুরু করে, যা এখনো চলমান রয়েছে। এই অনুসন্ধানের মধ্যেই আবারো দাতো আমিন নুর ও দাতো হানিফ নতুন করে ‘মেডিক্যাল সিন্ডিকেট’ করার চেষ্টা করছেন বলে ইতোমধ্যে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে অভিযোগ উঠেছে। এরমধ্যে বর্তমান দাতো আমিন নুরকে ‘আই নজরদারির (চক্ষু নজরদারি) মধ্যে দেশটির সরকার রেখেছে বলে জানা গেছে। অপর দিকে অভিযোগ রয়েছে, গত সেপ্টেম্বরে মাহাথির মোহাম্মদের ঘনিষ্ঠজন পরিচয় দেয়া দাতো ড. রইস হোসনির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল দুই দফা বাংলাদেশ সফর করে। সে সময় প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী (তখন প্রতমিন্ত্রী) ইমরান আহমদ এবং সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির সাথে বৈঠক হয়। তারা পরে বায়রার নেতৃবৃন্দের সাথেও আলাদাভাবে বৈঠক করেন।

যদিও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেটের একজন সদস্য ছিলেন ইউনিক গ্রুপের কর্ণধার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নুর আলী। এবার তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি আর কোনো ধরনের সিন্ডিকেটের সাথে নেই। শুধু তাই নয়, গত রমজান মাসে হোটেল ওয়েস্টিনে এক ইফতার ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠানে তিনি তার বক্তব্য স্পষ্ট বলেছেন, শ্রমবাজারে কোনো ধরনের সিন্ডিকেট থাকবে না। ওই অনুষ্ঠানে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ছাড়াও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রৌনক জাহান, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সেলিম রেজা এবং বায়রার কয়েক শত সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877