শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৯:৪৪ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
স্বল্পআয়ের মানুষের কষ্ট পিছু ছাড়ছে না

স্বল্পআয়ের মানুষের কষ্ট পিছু ছাড়ছে না

স্বদেশ ডেস্ক:

রমজান মাস এলেই অস্থির হয়ে ওঠে নিত্যপণ্যের বাজার। তেল, ডাল, ছোলা, চিনি, দুধ, খেজুরসহ রোজাপণ্যের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ে। এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি, উল্টো দাম বৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয়েছে রোজার মাস দুয়েক আগেই। সেই সঙ্গে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে মাংসের দাম। বরাবরের ন্যায় বেগুন, কাঁচামরিচ, লেবুসহ সবজি কিনে খেতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ১৫ রোজা পার হলেও এতটুকু স্বস্তি ফেরেনি বাজারে। অন্যদিকে রোজা এলেই বাড়তি পণ্য কেনার হিড়িক পড়ে যায় বাজারে। সামর্থ্যবানদের এই অতিরিক্ত কেনাকাটা নিত্যপণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দেয়। আর তার মাসুল গুনতে হয় দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষদের।

রাজধানীর কদমতলী এলাকায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন মোসাম্মত লিপি বেগম। দুই হাজার ২০০ টাকা মাস চুক্তিতে চার বাসায় কাজ করে প্রতিমাসে আয় তার মোটে ৮ হাজার ৮০০ টাকা। আয়ের সামান্য এ টাকাতেই দুই সন্তান ও মাকে নিয়ে অনেক কষ্টে রোজার মাস পার করছেন স্বামী পরিত্যক্ত এ নারী। কথা হলে লিপি জানান, রোজায় বাড়তি মুখরোচক খাবার দূরে থাক দৈনিক রান্নায় প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে খেতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। একরাশ হতাশা নিয়ে বললেন, ‘রোজা এলেই ভয় লাগে। কারণ বাজারে সব কিছুর দাম রাতারাতি বাইড়া যায়। বড়লোকেরা ব্যাগ ভরে বেশি বেশি কেনাকাটা করে। দোকানদাররাও তাই দাম বাড়াইয়া দেয়। কিন্তু আমরা তো গরিব। আমাগোর জন্য তো আর আলাদা কইরা

কম দাম রাখে না। বাধ্য হইয়া অতিরিক্ত দাম দিয়াই জিনিসপত্তর কিনতে হয়। বড়লোক গো বিলাসিতার মাসুল দিতে হয় আমাগোরে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অন্যান্য বছর রোজার মাঝামাঝি দাম কিছুটা কমে। এবার আরও বাড়ছে। ইফতারে ছেলেমেয়েগুলারে একটু ভালোমন্দ খাওয়ানো তো দূরের থাক, ডাল-ভাত-তরিতরকারি খাইয়া পরিবার নিয়া যে রোজা রাখমু তাই পারতেছি না। আমাগোর এই কান্না কেউ দ্যাহে না।’

লিপির মতো রোজার মাসে বাজার করতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী মো. মিজানুর রহমানেরও। রায়েরবাগের বাসিন্দা মিজান বলেন, ‘রোজা আইলেই দাম বাইড়া যায়- এইটি একটি নিয়ম হইয়া গেছে। প্রত্যেক বছর এমনটি হইয়া আসতেছে। কিন্তু এর কোনো সমাধান হয় না। আমরা ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হইয়া আছি। বেতনের ১৫ হাজার টাকা দিয়া বাসা ভাড়া, ছেলেদের পড়াশোনার খরচ শেষে যা থাকে তা দিয়ে মাসের বাজারই হয় না। তার ওপর রোজার বাড়তি খরচ কীভাবে সামলামু বুইঝা পাই না। বড়লোকের পকেট ভরা টাকা, আমাদের তো আর তা নাই। রোজা রাইখা রোদের মধ্যে টিসিবির লাইনে দাঁড়াইয়াও পণ্য পাওয়া যায় না। কার কাছে যামু, কারে নালিশ দিমু?’

কেবল লিপি কিংবা মিজান নয়, রমজান মাসে বাড়তি খরচের চাপে দিশাহারা স্বল্প ও নিম্নআয়ের আরও অনেকে। লাগাতার বাড়তে থাকা বাজার খরচের চাপে বেশিরভাগ মানুষ ইফতার ও সেহরিসহ রোজায় খাবারের তালিকা ছোট করতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ প্রতিবারের মতো এবারও অনেক আগে থেকেই সরকার জনসাধারণকে ‘রোজায় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না’- এমন আশ্বাস দিয়ে এলেও বাজার ও ব্যবসায়ীরা হেঁটেছে পুরনো পথেই। এবারও রোজায় নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে লাগাম টানা যায়নি। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে উচ্চপর্যায়ে টাস্কফোর্স গঠন ও তদারকি অভিযান জোরদার করাসহ প্রয়োজনীয় ৪০ পণ্যের পাইকারি ও খুচরা দাম বেঁধে দিলেও এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বেশিরভাগ পণ্য এখনো অতিরিক্ত দামেই বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অতিঅল্প সময়ে অতিরিক্ত মুনাফা করে নিচ্ছে। প্রতিবছর রোজায় এমনটি হয়ে এলেও, এ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছেন না ভোক্তারা। বাজারে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে যে কারসাজি হচ্ছে- সেগুলো বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতারই উপসর্গ। উন্নয়নশীল দেশের বাজারব্যবস্থার সঙ্গে এসব সঙ্গতিপূর্ণ নয়, বরং সাংঘর্ষিক। এতে ভোক্তা ও উৎপাদক কারও স্বার্থই রক্ষা হচ্ছে না। এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘বাজার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের ত্রুটির সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা রোজায় পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে সামর্থ্যবানরা প্রয়োজনের বেশি অতিরিক্ত পণ্য কেনায় বাজারে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। এর মাসুল দিতে হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে। কারণ তাদের রোজায় খাদ্যপণ্যের পেছনে বাধ্য হয়ে বেশি খরচ করতে হচ্ছে।’ পণ্য সরবরাহের এক-চতুর্থাংশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘পণ্যের চাহিদা, মজুদ ও সরবরাহের পরিসংখ্যানে নিবিড় মনিটরিং দরকার। এ তথ্যগুলো পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা হলে রোজায় যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে সেগুলোর দাম রাতারাতি বাড়তে পারে না। চাহিদার এক-চতুর্থাংশ সরকার সরবরাহ করলে পণ্য মূল্য লাফিয়ে বাড়তে পারবে না। পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও পণ্য পরিবহনসহ বিভিন্ন ধাপে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।’

বাজার চিত্র বলছে, এক মাসের ব্যবধানে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, মসুর, ছোলা, এঙ্কর ডাল, সবজি ও মাংসের মতো পণ্যের দাম নিম্নআয়ের ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সরু চালের পেছনে কেজিপ্রতি ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। মোটা চালেও কেজিপ্রতি ১ থেকে ২ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। মাসের ব্যবধানে খোলা আটার কেজিতে দাম বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত। একইভাবে চিনির কেজিতেও ২ টাকা বেড়েছে। প্রথম রোজা থেকে এক লাফে কেজিতে ৫ টাকা দাম বেড়েছে ছোলার। বর্তমানে ৭৫ টাকার নিচে মিলছে না রোজায় ইফতারে ব্যবহৃত এ পণ্যটি। একইভাবে অন্যান্য ডালের দামও বেড়েছে। এঙ্কর ডালের কেজিতে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৬০ টাকায়। রোজায় স্বল্পআয়ের মানুষের বড় দানার মসুর ডালের দামও কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অপরদিকে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল একরকম উধাও। পাওয়া গেলেই বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। খোলা সয়াবিনের কেজিতেও ৪ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এরই মধ্যে এবার আগভাগেই বাড়তে শুরু করেছে সুগন্ধি চাল, সেমাই, দুধ, চিনি ও মসলাসহ ঈদসামগ্রীর দামও।

রোজার আগে সবজির বাজারে অস্বস্তি থাকলেও ৫০ টাকার নিচে পাওয়া গেছে বেশ কিছু সবজি। কিন্তু প্রথম রোজা থেকে সব তরিতরকারির দাম বেড়েছে। বেশিরভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকার ওপরে। এর মধ্যে অনেক সবজি বিক্রি হচ্ছে ৭০-১১০ টাকার মধ্যে। বরাবরের মতো রোজায় লম্বা বেগুনের দাম হুট করেই ৮০-১১০ টাকায় ঠেকেছে। সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে কাঁচামরিচ। টক বেড়েছে লেবুর দামেও। বাজারে প্রতি হালি লেবু বিক্রি হচ্ছে ৫০-৮০ টাকার মধ্যে। অপরদিকে রোজায় গরিবের প্রোটিনের সহজলভ্য উৎস ব্রয়লার মুরগির দামটাও লাফিয়ে দেড় শতকের ঘর ছাড়িয়েছে। আগে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় পাওয়া গেলেও প্রথম রোজা থেকে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা কেজি দরে। প্রতিকেজি গরুর মাংসের দামও ৬০০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫০ থেকে ৬৮০ টাকা কেজিতে গিয়ে ঠেকেছে।

এবার খেজুরের আমদানি অনেক বাড়লেও বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘রোজার সময় দেশে ৪০ হাজার টন চাহিদা রয়েছে। সেখানে এ বছর রোজা কেন্দ্র করে ৫০ থেকে ৫২ হাজার টন খেজুর আমদানি হয়েছে। কাস্টমসের সূত্রও বলছে, গত ৯ মাসে দেশে ৭৪ হাজার ৮১ দশমিক ৫৭৭ টন খেজুর আমদানি হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের কিছু খেজুর অবিক্রীত রয়ে গেছে। এতসবের পরও প্রথম রোজা থেকেই খেজুরের দাম লাফিয়ে বেড়েছে। রমজান উপলক্ষে এক মাসের ব্যবধানে ব্র্যান্ডভেদে কার্টনপ্রতি (১০ কেজি) খেজুরের দাম ১০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। একইভাবে আপেল, মাল্টা, তরমুজ, কলাসহ সব ধরনের ফলের দামেও আগুন লেগেছে যেন। বাজারে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। দেশি চাম্পা কলার ডজন এখন ৭০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত এবং সাগর কলার ডজন বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত। এক পিস বেলের দামও কিনতে হচ্ছে (আকারভেদে) ১২০ থেকে ২০০ টাকায়। সরকারি সংস্থা ট্রেড করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবও বলছে, এক মাসের ব্যবধানে বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে।

মালিবাগ বাজারের গাজী স্টোরের মো. মাসুদ রানা, কারওয়ানবাজার কিচেন মার্কেটের ঢাকা জেনারেল স্টোরের মো. মুজাহিদ, মাতুয়াইল বাজারের মিলন স্টোরের মো. মিলন হোসেনসহ রাজধানীর খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন- কেবল যে খোলা পণ্য তা নয়, রোজার আগমুহুর্তে বড় বড় কোম্পানিগুলোও পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। রোজায় চাহিদা বাড়ে যায় এমন সব পণ্যের দাম রমজানের এক সপ্তাহ আগেই বেড়েছে। আটা, ময়দা, চিনি, দুধ, সরবত, বেসন, সেমাইসহ অনেক পণ্যের দাম প্রথম রোজা থেকে আরও বাড়তে শুরু করেছে। ভোজ্যতেলের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে এখনো কৃত্রিম সংকট ধরে রেখেছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ কাজে আসছে না। পাশাপাশি সমন্বয়হীনতাও রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো এসএম জুলফিকার আলী। সম্প্রতি ‘খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনের সেমিনারে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় তিনি বলেন, ‘মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার সঠিকভাবে বাজার ব্যবস্থাপনা ও তদারকি করতে পারছে না। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ওপর থেকে কী সিগন্যাল দিচ্ছেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। সরকারের উদ্যোগ ভালো হলেও তা বাজারব্যবস্থার পরিপূরক কোনো ব্যবস্থা নয়। তাই ন্যূনতম জীবনমান বজায় রেখে যাতে দরিদ্র জনগণ চলতে পারে, সরকারকে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বাজার মনিটরিংয়ের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার আমাদের সময়কে বলেন, ‘রমজানে বেশি চাহিদা থাকে এমন পণ্যগুলোর বাজারে আমরা নজর রাখছি। পাশাপাশি সম্প্রতি ভোরবেলা বাজারে পণ্যের ট্রাকগুলোতেও নজর রাখা হচ্ছে। এর পরও তেল, বেগুন, শসা, লেবু, তরমুজসহ অনেক পণ্যে কারসাজির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা খতিয়ে দেখছি। কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী পাইকাররা যাতে ২০ শতাংশ এবং খুচরা বিক্রেতারা ৩০ শতাংশের বেশি মুনাফা (খরচ বাদ দিয়ে) করতে না পারেন সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877