মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ০২:০০ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
সিলেটের কিলিং জোন ওসমানী ফটক

সিলেটের কিলিং জোন ওসমানী ফটক

স্বদেশ ডেস্ক: তুচ্ছ ঘটনা। স্থানীয়রা বলছেন, কথাকাটাকাটি। এর জের ধরে তরুণের  বুকে-পিঠে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত। শ’ শ’ মানুষের চোখের সামনেই দৃশ্য। নির্দয়ের মতো ছুরিকাঘাতে এক সময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তরুণ নাজিম উদ্দিন। স্থানীয়রা এগিয়ে এলেন। গুরুতর অবস্থায় তাকে পাশের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলেন। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করলেন।

বাঁচাতে পারলেন না নাজিম উদ্দিনকে। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয়রা। ঝাপটে ধরে এক খুনিতে ঘটনাস্থল থেকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছেন। গত শনিবার রাত ১০টার দিকে এমন ঘটনা ঘটেছে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধান ফটকের কাছে। ওই এলাকাটি সিলেট শহরের কিশোর গ্যাংয়ের পরিচিত আড্ডাস্থল। এর আগেও কিশোর গ্যাংয়ের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বসহ তুচ্ছ ঘটনায় খুনোখুনি হয়েছে। এবারের ঘটনাও তাই। ওসমানীর জরুরি বিভাগের সামনে। এখানে কয়েক বছর ধরে কিশোর গ্যাং অবস্থান করে। নানা অপকর্ম ঘটে ওই এলাকায়। কয়েক মাস আগে র‌্যাবের কয়েকটি অভিযানে অন্তত ৩০ জন কিশোর গ্যাং সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছিল। তখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছিল। এবার রমজানের মাস খানেক আগে থেকে ফের সরব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ইমার্জেন্সি ফটকের সামনেই তাদের অবস্থান। এ কারণে এলাকায় ইমার্জেন্সি কিশোর গ্যাং নামে পরিচিত তারা। স্থানীয়রা ভয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেন না। গতকাল স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতিদিনের মতো শনিবার রাতেও জরুরি বিভাগের প্রধান ফটকের বাইরে অবস্থান নেয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। নানা বিষয় নিয়ে তারা আলোচনা, কখনো চিৎকার, আবার কখনো খেলার ছলে দৌড়ঝাঁপ করে তারা। রাত ১০টার কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ কিশোর গ্যাংয়ের স্থল থেকে চিৎকারের আওয়াজ আসছিল। কয়েকজন তরুণ হাতে ছুরি নিয়ে সহযোগী এক তরুণকে কোপাচ্ছিল। আর ওই তরুণ ঘটনার সময় চিৎকার করছিল। কয়েকটি ছুরিকাঘাতের পর মাটিতে লুটে পড়ে। এতে হামলাকারী যুবকরা পিছু হটে। স্থানীয়রা এসে ওই রক্তাক্ত অবস্থায় ওই তরুণকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ভর্তির পর ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেননি। মৃত ঘোষণার পরপরই স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ লোকজনের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। এ সময় ইমার্জেন্সি ফটকের কাছ থেকে ধাওয়া করে তারা খুনোখুনিতে জড়িত এক তরুণকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত তরুণ নাজিম উদ্দিনের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার শেলবরষ গ্রামে। তার পিতার নাম নুর উদ্দিন। পিতা-মাতার সঙ্গে নগরীর দরগাহ মহল্লায় বসবাস করতো সে। স্থানীয় একটি হোটেলের কর্মচারী ছিল। পিতা নুর মিয়াও হতদরিদ্র। খুনের খবর পেয়ে রাতেই ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসেন নুর মিয়া ও তার স্ত্রী। এ সময় ছেলের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। নুর মিয়া জানিয়েছেন, ইফতারের আগেই ঝগড়া করে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছিল নাজিম। এরপর তার কোনো খবর মেলেনি। এখন হাসপাতালে এসে লাশ দেখলাম। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে মর্গে প্রেরণ করেছে। ঘটনার পর সিলেটের সিলেট কোতোয়ালি থানার ওসি আলী মাহমুদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কিশোর গ্যাংয়ের সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্ব থেকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ ইতিমধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলে জানান তিনি। এদিকে, মেডিকেল রোডের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকে খুনের ঘটনাস্থলে একটি মোটরসাইকেল পড়ে রয়েছে। সেটি কেউ নেয়নি, কিংবা পুলিশও উদ্ধার করেনি। ফলে মোটরসাইকেল নিয়ে এলাকায় রহস্য দেখা দিয়েছে। ঘটনার পর থেকে এলাকায় আর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দেখা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের মতে- ওসমানী মেডিকেল এলাকায় ৪টি কিশোর গ্যাং চক্র সক্রিয় রয়েছে। এরমধ্যে গোটা শহরেই ইমার্জেন্সি গ্রুপ পরিচিত। তারা বসে ইমার্জেন্সি ফটকের সামনে। আলবাহার হোটেল গলি, শাপলার হোটেলে পেছন পর্যন্ত ওই গ্যাং চক্রের পরিধি। তাদের নেতৃত্বে এলাকায় নানা ঘটনা ঘটে। কিশোর গ্যাংয়ের কারণে ভয়ঙ্কর এলাকা হিসেবে পরিচিত পেয়েছে ইমার্জেন্সি ফটক এলাকা। বখে যাওয়া কিশোর, দোকান, মেডিকেল কর্মচারী ও পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ে ওই কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরে তারা। শেল্টার পায় ছাত্রলীগের সুজন গ্রুপ, শামীম গ্রুপ ও সাগর গ্রুপের। ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করার কারণে মাঝে মধ্যে পুলিশের সদস্যরা এসে কিশোর গ্যাংদের সঙ্গে আড্ডা দেন। ইমার্জেন্সির সামনে গত ৪ বছরে ৪টি ভয়ঙ্কর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় ডন হাসান নামের এক নিয়ন্ত্রক, কেএম শামীম ও এক সিএনজি চালককে ধাওয়া করে হত্যা করা হয়েছে ইমার্জেন্সি ফটকের কাছে। প্রতিটি হত্যার ঘটনা আলোচনায় জন্ম দেয় সিলেটে। সর্বশেষ শনিবার রাতে হোটেল শ্রমিক নিজাম উদ্দিনকে খুন করা হয় এখানেই। খুনোখুনির কারণে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে এলাকা। এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত। এরপরও অপরাধ কমে না। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতি সপ্তাহে কিশোর গ্যাংয়ের কাছে কেউ না কেউ আহত হয়। ছুরিকাঘাত করা হয়। পরবর্তীতে হামলার শিকার হওয়া ব্যক্তিকে ম্যানেজ করা হয়। ফলে অধিকাংশ ঘটনারই মামলা হয় না। এতে করে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ওসমানী মেডিকেলের ভেতরেও রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তৃতি। তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে হোস্টেলে থাকা ছাত্রী, নার্স ও নারী ইন্টার্নরা। ওসমানীর জরুরি বিভাগের সামনে রয়েছে আউটডোর ভবন। এ ভবনের নিচতলা ও আশপাশ এলাকায় অবস্থান করে কিশোর গ্যাংয়ের একটি অপরাধী গ্রুপ। তাদের টার্গেটে থাকে হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা। তারা অভিযোগ করেছেন, ওসমানীর জরুরি বিভাগের নির্জন এলাকায় সন্ধ্যার পর অবস্থান নেয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এরপর ওই এলাকা দিয়ে মানুষ গেলে টাকা, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়া হয়। কিশোর গ্যাংয়ের আরেকটি শক্তিশালী গ্রুপ রয়েছে ১নং ফটকের সড়কের ফটক ও ভেতরের অংশে। বিকাল হলেই কিশোর ও তরুণরা এসে জড়ো হতে থাকে। আর সন্ধ্যা নামলেই শুরু হয় তাদের অপকর্ম। ইয়াবা বিক্রি এবং সেবন ও ছিনতাই বেড়ে যায় ওই এলাকায়। তাদের হাতে আক্রান্ত হন হাসপাতালের ডাক্তার, শিক্ষার্থী, নার্স ও স্টাফরা। স্থানীয় একটি ছাত্রলীগের গ্রুপের পরিচয়ে চলে ওই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ভেতরে নার্স হোস্টেল, ইন্টার্ন হোস্টেলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে আরেকটি কিশোর গ্যাং চক্র। বিকালে মাঠে খেলার ছলে তারা ভেতরে ঢোকে। আর সন্ধ্যা নামলেই পুরো এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তারা মাঠের কোনায়, রাস্তার উপর, নার্সিং হোস্টেলের সামনে আড্ডা দেয়। একইসঙ্গে মাদক সেবনও করে। তাদের অবস্থানের কারণে ওই এলাকায় চুরি, ছিনতাই বেড়ে গেছে বলে স্থানীয় নার্সিং ও ইন্টার্ন শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন। তারা জানান, ওখানে যারা আড্ডা মারে তারা অনেকেই বখাটে। কোনো স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী নয়। তারা বখাটে হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তাদের কারণে গোটা হাসপাতাল এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়া ছাড়াও খুনোখুনি বেড়ে গেছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877