স্বদেশ ডেস্ক: টিকা গ্রহীতার নাম জিয়াউর রহমান, বয়স ৪৯ বছর। ঠিকানা উপশহর পাড়া, ঝিনাইদহ। সরকারি ‘সুরক্ষা’ ওয়েবসাইটে গত ৬ মার্চ টিকা পেতে তিনি নিবন্ধন করেন। অথচ বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, নিবন্ধনের এক মাস আগেই তিনি দুই ডোজ টিকা গ্রহণ সম্পন্ন করেছেন। সার্ভারের তথ্যে দেখা গেছে, টিকা কার্ডে তার প্রথম টিকা গ্রহণের তারিখ দেখানো হয়েছে ১১ জানুয়ারি ২০২২ এবং দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২। সার্ভারের তথ্যে ‘এমআইএস এডিট’ উল্লেখ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগ থেকে এ ধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ কাজ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, টিকার জন্য নিবন্ধন, এসএমএস দেওয়া এবং টিকা গ্রহণের সনদ ইত্যাদি বিষয়ের দায়িত্বে রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখা। সেখানেই রয়েছে গলদ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে ‘সুরক্ষা’ ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে অনেককেই নানা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই টিকা কার্ড এবং টিকা সনদের তথ্যে মিল পাওয়া যাচ্ছে না। টাকার বিনিময়ে ব্যাকডেটে টিকা প্রদান দেখিয়ে তথ্য আপডেট ও সনদ দেওয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এমআইএস শাখার কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের পরিবার-পরিজনের মধ্য থেকে লোক নিয়োগ দিয়েছেন। এদের নিয়ে এমআইএসে দুটি গ্রুপ রয়েছে। যারা তিন হাজার টাকার বিনিময়ে ব্যাকডেটে টিকা কার্ড সংশোধন ও সদন প্রদান করছে।
সূত্র জানায়, সার্ভারের এক্সেস দুটি। একটি দিয়ে শুধু এসএমএসের শিডিউল করা যায়। এটির পাসওয়ার্ড সেখানে কর্মরত সবার কাছেই আছে। অন্যটি দিয়ে ব্যাকডেটসহ টিকার নাম পরিবর্তনসহ অন্যান্য কাজ করা যায়। এটির এক্সেস শুধু চারজনের কাছে রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন একজন উপ-পরিচালকের ড্রাইভারের গ্রাম সম্পর্কিত স্বজন, আরেক
উপ-পরিচালকের ভাগ্নে, এ ছাড়া দুজন আছেন প্রভাবশালী সিসটেম অ্যানালিস্টের শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়। এদের কাছে এমআইএসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সার্ভারের পাসওয়ার্ড থাকে। যদিও তারা কেউই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্থায়ী কর্মী নন, আউটসোর্সিং কর্মী। অন্যদিকে নিচে যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে একজন সহকারী পরিচালকের আত্মীয়, একজন মেডিক্যাল অফিসারের আত্মীয়, একজন ইউএনএফপিএর কর্মী, একজন উপপরিচালকের আত্মীয় এবং আরেক জন স্টাটিশিয়ানের জামাতা। এদের বিষয়ে এমআইএসে কর্মরত সবাই কমবেশি জানেন। তবে তারা প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ কিছু বলার সাহস পান না।
অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এমআইএসের এই অনৈতিক কর্মকা-ের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পরে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। জানতে চাইলে এমআইএস পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, এ ধরনের কোনো বিষয় তারা জানা নেই।
গত ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বরাবর টিকার সনদ পেতে আবেদন করেন সাপ্তাহিক যুগবার্তা সম্পাদক রফিকুল ইসলাম সুজন। সেখানে তিনি লেখেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি টিকার প্রথম ডোজ এবং ১৫ এপ্রিল দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করেন। কিন্তু টিকা সনদ নিতে পারছেন না। এই আবেদনের সঙ্গে তিনি তার টিকা কার্ডের কপি সংযুক্ত করেন। এ বিষয়ে হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা তাকে জানান, তিনি যে টিকা নিয়েছেন সে তথ্য সার্ভারে ইনপুট দেওয়া হয়নি। তাই কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তাকে ওই সময়ের সনদ দেওয়া সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে তাকে নতুন করে নিবন্ধন করতে হবে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রথম ডোজ এবং ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় ডোজের তথ্য সার্ভারে সংযুক্ত করে সনদ দেওয়া হবে। এর দুই মাস পরে তিনি টিকার বুস্টার নিতে পারবেন এবং টিকা কার্ড পাবেন। এই ভোগান্তির কারণে তিনি ভিসা করেও দেশের বাইরে যেতে পারছেন না।
এদিকে হাবিবুর ভূইয়া নামে এক ব্যক্তির টিকা কার্ড দেখতে সম্পূর্ণ সরকারি কার্ডের মতো। তবে সেটির কিউআর কোড স্ক্যান করে অন্য একটি নকল সাইটের তথ্য দেখা যাচ্ছে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী টিকার সনদ নিয়ে অবৈধ বাণিজ্য ও প্রতারণা থেমে নেই। আইটিতে (ইনফরমেশন টেকনোলজি) দক্ষ এক শ্রেণির প্রতারক একের পর এক ‘সুরক্ষা’ ওয়েবসাইট নকল করে প্রতারণা করছে। হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষ করে বিদেশগামী যাত্রীদের চাহিদামতো টিকার নাম ও প্রয়োজনীয় সময়ের সনদ দিয়ে তারা বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই জালিয়াত চক্র ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে টিকা সনদ বিক্রি করছে। এমডি আরিফ নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে এমন একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘স্বল্প খরচে ১০ মিনিটে কিউআর-কোড ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট’। একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরও দেওয়া হয়েছে। তবে সরাসরি ফোন করলে সেটি রিসিভ করা হয় না।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এআইএস) অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, সুরক্ষার নকল সাইটের বিষয়ে আমরাও জেনেছি। তাদের একটা সাইট বন্ধ করে দিলে আরেকটা সাইট খুলে প্রতারণা করে যাচ্ছে। এটি নিয়ন্ত্রণ এমআইএসের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।