স্বদেশ ডেস্ক:
গ্রেফতার-রিমান্ডসহ নিত্য-নতুন মামলার খড়গ কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না বিএনপির। হঠাৎ করেই মামলা ও গ্রেফতারের চাপে পড়েছে রাজপথের এই প্রধান বিরোধী দল। দলের সিনিয়র নেতারা জানান, আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। এ অবস্থায় মামলা দিয়ে বিএনপিকে কাবু রাখতে চায় সরকার। এ ছাড়াও রয়েছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি। সে নির্বাচনে অনেক নেতাকেই অযোগ্য ঘোষণা করতে চায় সরকার। এসব কারণেই নেতা-কর্মীদের চাপে রাখতে সরকারের নির্দেশে নতুন করে মামলা দিচ্ছে পুলিশ। তারা বলেন, অনেক স্থানে পুরনো মামলাগুলোও সচল করে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। আবার চার্জশিটও দেওয়া হচ্ছে। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে রায়ের প্রক্রিয়া।
এসব মামলা ‘মিথ্যা ও বানোয়াট’ আখ্যা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই সরকার আপাদমস্তক একটা স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় বলেই সাধারণ মানুষের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। অবৈধ এ ক্ষমতাকে ধরে রাখতেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের ‘স্টিম রোলার’ চালাচ্ছে। কথায় কথায় গণহারে এই ‘ভুয়া ও গায়েবি’ মামলা দেওয়াটা এখন তাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। দেশকে বিরোধী দলশূন্য করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এ সরকার। তবে সময় আর বেশি দিন নেই। জনগণ রুখে দাঁড়াতে শুরু করেছে। গণআন্দোলনের মাধ্যমে অচিরেই বিদায় নিতে হবে তাদের।
বিএনপির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার অভিযোগ, একটি মামলার বিপরীতে বছরখানেক আগেও আসামি করা হতো বড়জোর কয়েক ডজন নেতা-কর্মীকে। আর এখন আসামি করা হচ্ছে শত শত। নয়াপল্টনে গত রবিবারের সংঘর্ষের ঘটনায় চার শতাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এ মামলায় প্রথম দিন ৬২ জনের নাম উল্লেখ করা হলেও বাকি ঘরগুলো খালি রেখে পর্যায়ক্রমে পূরণ করা হচ্ছে। পল্টন থানায় দায়ের করা এ মামলায় ইতোমধ্যে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ৩৩ জনকে। এরমধ্যে ১০ জনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সারা দেশের জেলা-উপজেলাসহ প্রতিটি এলাকায় এভাবে গণহারে মামলা দিয়ে আসছে পুলিশ। তৃণমূলের সক্রিয় নেতা-কর্মীদের তালিকা করে তাদের বাসায় প্রতিদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ বিএনপি নেতাদের।
জানা গেছে, গত বছরের ২৭ অক্টোবর রাজধানীর পল্টন থানায় দেড় হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অজ্ঞাত পরিচয় দেখিয়ে মামলা করে পুলিশ। গত ২২ ডিসেম্বর হবিগঞ্জে পুলিশ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনার পর ২ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। একই ঘটনায় ৫ জানুয়ারি জেলা পরিষদের রেস্টহাউস ভাঙচুরের অভিযোগে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীসহ অজ্ঞাত পরিচয় আরও চার শতাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দেওয়া হয়। গত ৩০ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ শহরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ছয়টি মামলা করা হয়। এ মামলায় আসামি করা হয় সহস্রাধিক বিএনপি নেতা-কর্মীকে। সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, ইটপাটকেল ও দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে পুলিশকে আহত করা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অভিন্ন অভিযোগ আনা হয় তাদের বিরুদ্ধে।
বিএনপি কেন্দ্রীয় দফতরের হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে এ পর্যন্ত বিএনপির ৩৬ লাখেরও বেশি নেতা-কর্মী ও সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলার সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি। দলীয় নেতাদের অভিযোগ, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন থেকেই এই মিথ্যা মামলা ও হামলা, গ্রেফতার-রিমান্ডের মতো হয়রানি-নির্যাতনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যে, একই দিনে বিভিন্ন থানায় একই নেতার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। একই আসামি একই সময়ে উত্তরা থানা ও যাত্রাবাড়ী এলাকাতে গিয়ে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেছে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে। আবার সেই একই ব্যক্তিই মাত্র ২০ মিনিটের ব্যবধানে যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলী, মিরপুর এলাকায় গিয়েও অপরাধ করেছে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের শত শত ‘ভুতুড়ে ও গায়েবি’ মামলা দায়ের করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি এসব মামলাকে ‘রহস্যজনক’ ও ‘অবিশ্বাস্য’ আখ্যা দেন। অবশ্য তাঁর (মির্জা ফখরুল) নিজের নামেও ‘নয়াপল্টনে শীতের দিন ভোর ৫টার সময় ময়লার গাড়ি ভাঙচুর’ করার অভিযোগে পল্টন থানায় মামলা রয়েছে। কয়েক বছর আগের সেই মামলায় চার্জশিটও দিয়েছে পুলিশ।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তাঁর উন্নত চিকিৎসার দাবিতে এক মাস আগে আহূত জেলা পর্যায়ের সমাবেশকে ঘিরে হবিগঞ্জ ছাড়াও ফেনী, নরসিংদী, চট্টগ্রামসহ আরও ১৮টি জেলায় মামলা করে পুলিশ। মাত্র কয়েকটি মামলায় আসামি করা হয়েছে কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে। তার মধ্যে নরসিংদীতে গত ২৪ নভেম্বর বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনসহ ২০০ জন এবং ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামে বিএনপির মানববন্ধনে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় ৭৫ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয় পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মীকে আসামি করে মামলা দেওয়া হয়।
প্রতিটি মামলায় বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীকে আসামি করার কারণটা কী? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অবৈধ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই সরকারের এই দমননীতি। এর প্রতিটি মামলাই মিথ্যা, বানোয়াট ও ভুয়া। সরকারের লুটপাট ও ব্যর্থতার বিরুদ্ধে যাতে কেউ কোনো কথা না বলতে পারে, কোনো ধরনের প্রতিবাদ করতে না পারে, তার জন্যই মিথ্যা মামলায় এসব হয়রানি। এসব নতুন কিছু নয়। নতুন বিষয় হলো- জনগণ এখন রাস্তায় নামতে শুরু করেছে। সরকারের সামনের পথ সরু হয়ে যাচ্ছে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হলে এসব মামলা একটাও থাকবে না ইনশা আল্লাহ। তবে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গণহারে এই মামলা দায়েরের ঘটনায় অনেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেফতার বাণিজ্যকেও দায়ী করেছেন।
এসব বিষয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, এসব নতুন কিছু নয়। মামলা ও গ্রেফতারের মাধ্যমে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বন্দি করা আওয়ামী লীগের পুরনো কৌশল। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে গায়েবি ও মিথ্যা মামলা দিয়েছে। এসব মামলার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। আসলে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে তারা এসব মিথ্যা মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়। কিন্তু আর কোনো কৌশল করে তাদের শেষ রক্ষা হবে না।