স্বদেশ ডেস্ক:
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যামামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে সোমবার। গত ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত দেশের বহুল আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ২৮৮ পৃষ্ঠার রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ওসি প্রদীপের নানা বিষয় তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে প্রদীপকে বিপিএম পিপিএম পদক দেওয়ায় পদকের সম্মান ভ‚লুণ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করেন আদালত।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানান, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যামামলার রায় ৩১ জানুয়ারি ঘোষণা করেন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। তিনি বলেন, এত অপর্কম করার পরও ওসি প্রদীপের মতো একজন বিতর্কিত পুলিশ অফিসারকে বিপিএম, পিপিএম পদকে ভূষিত করা পুলিশ বাহিনীর জন্য লজ্জার বলে মনে করেন আদালত।
বিচারক রায়ে বলেন, যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, তার বিচারপ্রাপ্তির সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে জাতির জনক বাঙালি জাতিকে যে সংবিধান উপহার দিয়েছেন সেই সংবিধানে আইনের শাসন এবং প্রত্যেক মানুষের বিচারপ্রাপ্তির সাংবিধানিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
অথচ বরখাস্ত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশের মতো পুলিশ অফিসার আইনের রক্ষকের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থেকে আইনের শাসন ও সংবিধানকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন। কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে ধারাবাহিকভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ তার দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
সিনহা হত্যামামলার রায়ে ওসি প্রদীপের বিপিএম-পিপিএম পদক নিয়ে সমালোচনা করে বিচারক আরও বলেন, তার অতীত রেকর্ড খারাপ হওয়া সত্তে¡ও তাকে একাধিকবার বিপিএম, পিপিএম পদকে ভ‚ষিত করায় ওই পদকের মর্যাদাকে ভ‚লুণ্ঠিত করা হয়েছে। রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়, আসামি প্রদীপ কুমার দাশ বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যাকাÐের শিকার হওয়াদের ডাকাত, মাদক ব্যবসায়ী, মানবপাচারকারী হিসেবে সাব্যস্ত করে হত্যাকাÐ ঘটিয়ে ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়েছেন। প্রায় প্রত্যেক হত্যাকাÐের শিকার ভিকটিম/ভিকটিমদের নিকটাত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশীসহ ৩০-৪০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা, একটি মাদক এবং একটি অস্ত্র মামলা করতেন।
মেজর (অব) সিনহা মো. রাশেদ খান ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকাÐের ২০৫তম শিকার।
রায়ে বলা হয়েছে, এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্ক শুনানিকালে ১০৪ জন ভিকটিমের সুনির্দিষ্ট নাম-ঠিকানা দাখিল করেন, যারা ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের শিকার। সময় স্বল্পতার কারণে অবশিষ্টদের সুনির্দিষ্ট নাম-ঠিকানা উপস্থাপন করা যায়নি।
এতে দেখা যায়, ওসি প্রদীপ কুমার বহুদিন ধরে পরিকল্পিত, ষড়যন্ত্রমূলক ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাজানো ঘটনার অবতারণা করে, যখন যাকে ইচ্ছা খুন করার মানসিকতা ও প্রবণতা লালন করে আসছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী উল্লেখ করেছেন, আসামি ওসি প্রদীপ কুমার মেজর (অব) সিনহা হত্যামামলায় আটক না থাকলে এতদিনে তিনি ও তার অনুচরদের হাতে আরও বহুলোক বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকাÐের শিকার হতেন। এই আসামি প্রদীপ এমনই এক প্রদীপ, যার নিচে শুধুই অন্ধকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ওসি প্রদীপ, বিপিএম, পিপিএম পাওয়ার জন্য আবেদনের ক্ষেত্রে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মানুষ হত্যাকে মাদক নির্মূলে সফলতা হিসেবে উল্লেখ করে নিহতের সবাইকে মাদককারবারি দাবি করেছেন।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, ওসি প্রদীপ একজন নরপিশাচ খুনি। তিনি বলেন, আশা করি ভবিষ্যতে এমন বিতর্কিত কেউ আর পদকের জন্য বিবেচিত হবেন না।
এ মামলার সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট জিয়াউদ্দিন জিয়া বলেন, সোমবার মামলার রায় প্রকাশ হওয়ার পর তা উচ্চ আদালতে পাঠানো হবে। আসামিদের আইনজীবীরা সার্টিফিকেট কপিও পাবেন এখন। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্ট পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা।
গত ৩১ জানুয়ারি আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করে আদালত। রায়ে প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদÐ দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি আরও ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদÐ দেওয়া হয়। এ ছাড়াও বেকসুর খালাস পান সাতজন।
সাত পুলিশ সদস্যকে খালাস দেওয়া প্রসঙ্গে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন, এই আসামিরা নিজেরাসহ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা মতে, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানকারী আসামিরা বা সাক্ষীগণের জবানবন্দি পর্যালোচনায়, অত্র মামলার ঘটনা সম্পর্কিত ষড়যন্ত্র ও পূর্বপরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিল কিংবা ঘটনা সংঘটনকালে স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে কোনো কর্মকাÐে অংশগ্রহণ করেছে কিংবা কোনো অপরাধমূলক কর্মকাÐ করেছে মর্মে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। এক কথায়, এই অভিযুক্তরা তাদের ডিউটিরত চেকপোস্টে অবৈধভাবে কর্তৃত্ব গ্রহণকারী সশস্ত্র, মারমুখী ও অগ্নিশর্মা ইন্সপেক্টর মো. লিয়াকত আলীর নির্দেশ পালন করতে বাধ্য হয়েছেন।