স্বদেশ ডেস্ক:
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান (৩৬)। ১৮ মাস পর আজ সোমবার বহুল আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষণা করা হবে। গত ১২ জানুয়ারি যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের এই দিন ধার্য করেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাঈল। টেকনাফের বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। নিহত মেজর সিনহার পরিবারের দাবি, আসামিদের এমন শাস্তি যেন হয়, যা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ওসি প্রদীপের কঠোর শাস্তি চান উখিয়া-টেকনাফে তার হাতে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতিতদের পরিবারের সদস্যরাও।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, ওসি প্রদীপের পরিকল্পনায় মেজর সিনহাকে যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তা আদালতে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। সব আসামির অপরাধ প্রমাণ করতে পেরেছি আমরা। তাই রাষ্ট্রপক্ষ আশা করে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সবার সর্বোচ্চ সাজা হবে। তিনি আরও বলেন, মেজর সিনহা ছাড়াও ২০৪ জনের বেশি নিরীহ মানুষকে বিচারবহিভর্‚তভাবে হত্যা করেছে ওসি প্রদীপ। তাই এ নরপিশাচের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে বলে দেশবাসী আশা করে।
মামলার বাদী মেজর সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বলেন, সিনহাকে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই রায়ের মাধ্যমে দেশে বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে। বিশ্ববাসীর কাছে অন্যরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এ মামলার রায়। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন খান বলেন, বাদীপক্ষ আসামিদের অপরাধ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সেসব বিষয় আদালতকে অবহিত করেছি। তাই আমরা ন্যায়বিচার আশা করছি।
সিনহা হত্যার রায় উপলক্ষে কক্সবাজারে এসেছেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা। কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি শেখ মুনীর উল গীয়াস বলেন, রায় ঘোষণা কেন্দ্র করে আদালত প্রাঙ্গণে কড়া নিরাপত্তা থাকবে। মোতায়েন করা হবে অতিরিক্ত ফোর্স। বিচার চলাকালে আদালত প্রাঙ্গণে সর্বসাধারণের চলাচল সীমিত রাখা হবে। সিনহা হত্যা মামলার ১৫ আসামি কক্সবাজার কারাগারে আছেন।
সিনহা হত্যায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি এবং রামু থানায় একটি মামলা করে। সরকারি কাজে বাধা এবং মাদক আইনে এসব মামলা হয়। টেকনাফ থানার দুই মামলায় নিহত সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে আসামি করা হয়। আর রামু থানায় মাদক আইনের মামলায় আসামি করা হয় সিনহার আরেক সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে।
নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস ২০২০ সালের ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে প্রধান করে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এতে টেকনাফ মডেল থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপকে ২ নম্বর আসামি করা হয়। মামলার বাকি আসামিরা হলেন বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন এবং এএসআই লিটন মিয়া, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা। এ মামলার তদন্তভার পায় কক্সবাজারের র্যাব-১৫। পুলিশের করা তিনটি মামলার তদন্তও র্যাবের ওপর ন্যস্ত করেন আদালত। তদন্তে নেমে পুলিশের করা মামলার তিন সাক্ষী বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ ও নিজাম উদ্দিনকে এবং মেরিন ড্রাইভের তল্লাশিচৌকির দায়িত্বে থাকা এপিবিএনের তিন সদস্য এএসআই শাহজাহান মিয়া, কনস্টেবল রাজীব, আবদুল্লাহ ও রুবেল শর্মাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য আসামিরা আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরে পুলিশের তিনটি মামলার চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা থেকে সিফাত ও শিপ্রাকে অব্যাহতি দেন আদালত।
এর পর মামলার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহর আদালত থেকে জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে স্থানান্তর হয়। ২০২১ সালের ২৭ জুন আদালত বিচার শুরুর আদেশ দেন। ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য দেন। ১২ জানুয়ারি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।
অভিযোগ রয়েছে, প্রদীপ টেকনাফ ওসি থাকাকালে মাদক নির্মূলের নামে ২২ মাসে ১৪৪টি ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটান। তাতে মারা যায় ২০৪ জন। নিহতদের পুলিশ মাদক ও অস্ত্র কারবারি বললেও এলাকাবাসী বলছে, নিহতদের বেশিরভাই ছিল নিরীহ। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে একই পরিবারের তিন ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করার অভিযোগ আছে প্রদীপের বিরুদ্ধে। এ পরিবারের সদস্য মুহাম্মদ আলম বলেন, ‘খুনের শিকার’ তিন ভাইয়ের বউ এবং এতিম সন্তানরা কামনা করছে তাদের অভিভাবকদের হত্যায় জড়িত ওসি প্রদীপ ও অন্যদের যেন ফাঁসি হয়। তারা সপ্তাহে দুদিন রোজা রেখে, তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছে। তাদের প্রতিপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করে তার তিন ভাইকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করেন তিনি।
টেকনাফের বাহারছড়ার বৃক্ষপ্রেমিক হাবিবুল্লাহকে শুধু একটি বাগান দখল করার জন্য তার প্রতিপক্ষ থেকে টাকা নিয়ে ওসি প্রদীপ হত্যা করে বলে অভিযোগ করেন তার স্ত্রী খালেদা বেগম। তিনি বলেন, ওসি প্রদীপের আজকের মামলার রায়ে যেন ফাঁসি হয়। তা হলে আমার কষ্ট অনেকটা দূর হবে। আমার স্বামীর আত্মা শান্তি পাবে। এ জন্য আমি এক সপ্তাহ ধরে নফল রোজা রাখার পাশাপাশি প্রতি ওয়াক্ত নামাজে আল্লাহর কাছে দোয়া করছি।
ওসি প্রদীপের হাতে নির্যাতিত সাংবাদিক মোস্তফা বলেন, এ নরপিশাচের বিচার যেন দুনিয়ার মানুষ দেখতে পায়, মহান আল্লাহর দরবারে সেই ফরিয়াদ জানাচ্ছি।
এক নারী তার দুই মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ তুলেছেন ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। তিনিও প্রদীপের ফাঁসি কামনা করেছেন। ধর্ষণের ঘটনায় আদালতে মামলা করলেও এখনো মামলার কোনো কূলকিনারা পাননি বলে জানান তিনি।