স্বদেশ ডেস্ক:
সব শঙ্কা আর সংশয় কাটিয়ে শেরেবাংলা নগরের চিরচেনা ঠিকানা ছেড়ে পূর্বাচলের নতুন ভেন্যুতেই বসেছে এবারের ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। রাজধানীর পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে গত ১ জানুয়ারি ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে মেলা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন পরিসর ও নতুন আঙ্গিকে মেলা শুরু হলেও ২৬তম এ আসরে ক্রেতা-দর্শনার্থীর সমাগম এখনো পর্যন্ত অনেক কম। যারা আসছেন তারা আশপাশের এলাকার। রাজধানীর শেষ প্রান্তে ভেন্যু হওয়ায় নগরবাসীর মধ্যে মেলা নিয়ে আগ্রহ কম। বিশেষ করে যাওয়া-আসার দুর্ভোগ-ভোগান্তি নিয়ে অনেকের মধ্যে বিরাজ করছে এক ধরনের অনীহা।
বছরের শুরুতে বাণিজ্যমেলা ঘিরে আগারগাঁওয়ে যে উৎসবের আমেজ দেখা যেত পূর্বাচলের নতুন ঠিকানায় তার রেশ নেই। মেলা শুরুর সাত দিন অতিবাহিত হলেও এখনো জমে ওঠেনি মেলা। সবার নজর ছিল গতকাল ছুটির দিন শুক্রবারের দিকে। এদিন ভিড় কিছুটা বাড়লেও হতাশ হতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরা জানান, সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় ভিড় আরও বাড়বে বলে আশা করেছিলেন তারা। কিন্তু আশানুরূপ ক্রেতা-দর্শনার্থী সমাগম হয়নি।
মেলার ক্রিয়েটিভ জুট টেক্সটাইলের ব্যবসায়ী অজিৎ কুমার দাস বলেন, মেলা রাজধানী থেকে দূরে হওয়াতে রাজধানীর মানুষজন কম আসছে। আশপাশের এলাকা থেকেই বেশি মানুষ আসছেন। আমরা ভেবেছিলাম শুক্রবার রাজধানী থেকে ক্রেতা আগমন বাড়বে। কিন্তু ভিড় আশানুরূপ বাড়েনি। বিক্রিও নেই।
প্রাণ প্যাভিলিয়নের একজন বিক্রয়কর্মী নিয়াম আহমেদ বলেন, বেচা-বিক্রি এখনো জমে ওঠেনি। প্রথম ছয়দিন মানুষের উপস্থিতি কম ছিল। আজ (শুক্রবার) ভিড় কিছুটা বেড়েছে। তবে এবার মেলা প্রঙ্গণে আগের সেই আমেজ নেই।
নাদিয়া ফার্নিচারের অ্যাসিস্টেন্ট জেনারেল ম্যানেজার (সেলস্) মো. হেদায়েত উল্লাহও বলেন, মেলার ভেন্যু দূরে হওয়ায় এবং রাস্তাঘাটের ভোগান্তি থাকায় রাজধানীর কেন্দ্র থেকে মানুষ কম আসছেন। মেলায় আশপাশের এলাকা থেকেই বেশি মানুষ আসছেন। তারা কেবল ঘুরতেই এসেছেন, পণ্য কিনতে নয়। তাদের দিয়ে বাণিজ্যমেলার সার্থকতা আসবে না।
মেলার গেটের ইজারা নেওয়া প্রতিষ্ঠান মীর ব্রাদার্স জানায়, ঢাকার আগারগাঁওয়ের তুলনায় এখানে উপস্থিতি তুলনামূলক কম। মেলার প্রথম দিন সাড়ে ১১ হাজার মানুষ টিকিট কেটে প্রবেশ করেন। পরের দিন তা কমে সাড়ে ছয় হাজারে দাঁড়ায়। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রায় ৪৫ হাজার টিকিট বিক্রি হয়েছে। বাকি দিনগুলোও দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল কম। তবে গতকাল শুক্রবার তা বেড়েছে বলে ধারণা করছে প্রতিষ্ঠানটি। মীর ব্রাদার্সের ম্যানেজার মো. বাবু আমাদের সময়কে বলেন, শুক্রবারের টিকিট এখন গণনা করা হয়নি। তবে আমরা ধারণা করছি আজ দিনশেষে দর্শনার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার হবে।
মেলার গেট ইজারাদার (পরিচালনা কমিটির পরিচালক) মীর মানসুর আলম বলেন, ভেন্যু একটু দূরে হওয়ায় এখনো মানুষ কম আসছেন। তবে আমরা আশাবাদী দিন বাড়লে ভিড়ও বাড়বে।
প্রতিবছর নাদিয়াসহ মেলা প্রাঙ্গণে অন্যান্য ফার্নিচারের প্যাভিলিয়নের আয়োজন ও সাজসজ্জা থাকে চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এবার তা নেই। জানতে চাইলে হেদায়েত উল্লাহ্ বলেন, এবার মেলায় নানা সীমাবদ্ধতা দেওয়া হয়েছে। অন্যবার বড় প্যাভিলিয়নগুলো বহুতল ও নজরকাড়া ডিজাইনের হয়ে থাকে কিন্তু এবার তা করার সুযোগ নেই। ইনডোর হওয়ায় এবং নানা শর্ত থাকায় প্যাভিলিয়নের ডিজাইন সীমিত করতে হয়েছে।
গতকাল সরেজমিনে মেলা ঘুরে দেখা গেছে, অন্যবারের চেয়ে এবার মেলার প্রধান ফটকটি অনেকটা সাদামাটাভাবে করা হয়েছে। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে দেখা মিলবে পানির ফোয়ারার। হাতের বামে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন খোলা জায়গা ও বসার ব্যবস্থা। হাতের ডানে বেশ কতগুলো প্যাভিলিয়ন ও স্টল। দর্শনার্থীদের উজ্জীবিত করতে পাশেই দুটি সাউন্ড সিস্টেমে লাগাতার বেজে চলেছে গান। সামনে একটু এগোলেই মূল ভবন। ভবনে ঢুকতেই বঙ্গবন্ধু প্যাভিলিয়ন। এর ডানে ও বামে ইনডোর হলরুমের মধ্যে রয়েছে ছোট বড় প্যাভিলিয়ন ও স্টল।
মিনিস্টার, স্যামসাং, ওয়ালটন, প্রাণ, আরএফএল, যমুনা ইলেক্ট্রনিক্স, ইলেক্ট্রো মার্ট, বেক্সিফেব্রিক্স, বেঙ্গল গ্রুপ, হাতিল, ব্রাদার্স, আলীবাবা, আখতার, নাদিয়া, রিগ্যাল, নাভানাসহ প্রায় সব প্রতিষ্ঠান প্রস্তুতির কাজ সেরে নিয়েছে। তবে ইনডোর হওয়ায় মেলায় আগের মতো নেই কোনো বহুতল প্যাভিলিয়ন। করোনার জন্য স্টলগুলোর মাঝে রাখা হয়েছে নির্দিষ্ট দূরত্ব। সাজসজ্জায়ও নেই জমকালো ভাব।
রিগাল এম্পোরিয়ামের ম্যানেজার (সেলস্) রিপন কুমার দাস বলেন, প্রতিবার আমাদের প্যাভিলিয়নের আকার ও নকশায় নানা বৈচিত্র্য থাকত। তবে এবার ইনডোর হওয়ায় সে সুযোগ নেই। এক রকম সাদামাটা আয়োজনেই পণ্য সাজাতে হয়েছে আমাদের। চাইলেও সাজসজ্জার সেই জাঁকজমক ব্যাপারটা এবার করতে পারিনি আমরা।
মিনিস্টার কোম্পানির করপোরেট সেলের ডিভিশনাল ম্যানেজার এফএম মাহফুজ ইসলাম বলেন, এখানে মেলা আয়োজন হওয়ার কিছু ভালো দিকও রয়েছে। যেমন- এখানকার সবকিছু গোছানো, সবকিছুই একটা নিয়মমাফিকভাবে চলছে। তবে এটা সত্য যে ইনডোর হওয়ায় সাজসজ্জায় অনেক সীমাবদ্ধতা চলে এসেছে। অপরদিকে ভেন্যু দূরে হওয়ায় সাধারণ মানুষ পরিবার নিয়ে মেলায় আসতে আগ্রহ কম দেখাচ্ছেন।
মেলায় আগত বিভিন্ন শ্রেণির দর্শনার্থীর সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তাদের বেশিরভাগই এসেছেন রূপগঞ্জ, গাউসিয়া, নরসিংদী, গাজীপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকেও অনেকে এসেছেন। কিন্তু সবার মুখেই পাওয়া গেছে যাতায়াতে ভোগান্তির অভিযোগ। দর্শনার্থীরা জানান, ধলার রাজ্য পাড়ি দিয়ে আসতে হয় মেলায়। অন্যদিকে সরাসরি মেলায় আসার গণপরিবহন সংকট। তার ওপর রাস্তায় মেরামতের কাজ চলায় রয়েছে বাড়তি ভোগান্তি।
ফার্মগেট থেকে আসা মো. হানিফ সরকার বলেন, একটা কাজে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এসেছিলাম। সেখান থেকে কয়েকজন মিলে একটু মেলা দেখতে এলাম। কিন্তু আসার পথে যে ধুলাবালি খেতে হলো তাতে শখ মিটে গেছে। আর আসব না। তা ছাড়া ৩০০ ফিট রাস্তায় রাতে পরিবার নিয়ে চলাচল করতেও অনেক কষ্ট, নানা আতঙ্কও রয়েছে। গাড়িরও সংকট। তাই এখানে পরিবার নিয়ে আসা যাবে না।
যাত্রাবাড়ী থেকে আসা মো. রুবেল হোসেন বলেন, যাত্রাবাড়ী থেকে ডেমরা, সেখান থেকে গাউসিয়া, তার পর কাঞ্চন ব্রিজ এবং সব শেষে অটোরিকশা শেয়ারে চড়ে মেলায় এসেছি। এত কষ্ট করে এসে দেখি সাদামাটা আয়োজন। প্যাভেলিয়নগুলোও মনে হচ্ছে অনেক ছোট। কষ্টটাই বৃথা গেছে। মেলায় স্বস্তির বিষয়- টয়লেটের মান ভালো। ফ্রিতে ব্যবহার করা যায়।
মেলায় খাবারের ব্যবস্থা করতে মেলার ভেতরে পর্যটন করপোরেশনের ক্যান্টিন ছাড়াও আছে ১৫টি খাবারের স্টল। আর মেলার প্রাঙ্গণের বাইরে আছে স্থানীয় ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠিত কিছু খাবারের স্টল। শেরেবাংলা নগরের মেলার মাঠে ফুড কোর্টগুলোতে উল্লেখযোগ্য ভিড় দেখা গেলেও এখানকার ফুড কোর্টগুলোয় ভিড় তুলনামূলক কম। অন্যদিকে বাইরে থেকে আনা খাবার বাণিজ্যমেলার ভেতরে নিতে দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে।
নাদিয়া ফার্নিচারের অ্যাসিস্টেন্ট জেনারেল ম্যানেজার (সেলস্) মো. হেদায়েত উল্লাহসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, মেলায় প্রতিদিন সহস্রাধিক বিক্রয়কর্মী দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের জন্য বাইরে থেকে খাবার আনতে গেলে স্থানীয় কিছু লোক ফটক দিয়ে তা আনতে বাধা দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সচিব ও মেলা পরিচালক ইফতেখার আহমেদ বলেন, বাইরের খাবার ভেতরে নিতে আমাদের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা নেই। স্থানীয় কেউ হয়তো তাদের খাবার বিক্রির জন্য হয়তো কোনো ধরনের বাধা দিয়ে থাকতে পারে। তবে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
এদিকে মেলায় ক্রেতা-দর্শনার্থীদের কম উপস্থিতি নিয়ে বড় কোম্পানিগুলো চিন্তিত না হলেও ছোট ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির শঙ্কায় রয়েছেন। বেঙ্গল ব্রেইড অ্যান্ড রাগসের ব্যবসায়ী মো. কবির বলেন, করোনার চ্যালেঞ্জ নিয়েও মেলায় অংশ নিয়েছি। এতে খরচও করতে হয়েছে অনেক টাকা। ভেন্যুর জন্য ক্রেতা কম। তার ওপর করোনার নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ আতঙ্কও রয়েছে। মেলার বাকি মেয়াদে কেমন দিন যাবে তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছি আমরা।
অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার বিবিসিএফইসির ১৪ হাজার ৩৬৬ বর্গমিটার আয়তনের দুটি হলে মেলায় অংশগ্রহণকারী সব স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মেলা পরিচালক ইফতেখার আহমেদ জানান, মেলায় বাইরে ও ভেতরে ২২৫টি স্টল রয়েছে। করোনার কথা বিবেচনা করে মেলায় স্টলের সংখ্যা কমানো হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন ক্যাটাগরির মোট ২৩টি প্যাভিলিয়ন, ২৭টি মিনি প্যাভিলিয়ন, ১৬২টি স্টল ও ১৫টি ফুড স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তুরস্ক, ইরান, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ডসহ বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ১১টি স্টল রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বঙ্গবন্ধু প্যাভিলিয়ন।
প্রতিদিন মেলা সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এক ঘণ্টা বাড়তি সময়, অর্থাৎ রাত ১০টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকবে। মেলায় প্রবেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ৪০ টাকার টিকিট কাটতে হবে। শিশুদের জন্য টিকিটের মূল্য ২০ টাকা। মেলায় দর্শনার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে প্রতিদিন ৩৫টি বিআরটিসি বাস ও অন্যান্য যাত্রীবাহী বাস চলাচল করবে। এ জন্য জনপ্রতি ৪০ টাকা ভাড়া গুনতে হবে। যাত্রীদের কাঞ্চন ব্রিজ এলাকায় নেমে সেখান থেকে রিকশাযোগে মেলা প্রাঙ্গণে যেতে হবে।
দেশীয় পণ্যের প্রচার, প্রসার, বিপণন ও উৎপাদনে সহায়তা দিতে ১৯৯৫ সাল থেকে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা যৌথভাবে আয়োজন করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। পূর্বাচলের বিবিসিএফইসির পরিসর ছোট হওয়ায় মেলায় আগের চেয়ে কম প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এর আগে ২৫টি মেলা অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের খোলা জায়গায়।