বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ০৯:২৪ পূর্বাহ্ন

স্বজনদের বিদেশি নাগরিকত্বে কঠিন শর্তের পরামর্শ

স্বজনদের বিদেশি নাগরিকত্বে কঠিন শর্তের পরামর্শ

স্বদেশ ডেস্ক:

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ পুনরায় সংশোধনে হাত দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আগেও বিভিন্ন সময় এটি সংশোধন হয়েছে। তবে দুর্নীতি প্রতিরোধে বিধিমালাটি কখনই যুগোপযোগী করা হয়নি। ফলে এই বিধিমালা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুদ্ধাচার নিশ্চিত করতে পারছে না। এবারও সংশোধনে ঘুরেফিরে আগের বিষয়গুলোই থাকছে বলে জানা গেছে। ফলে প্রশাসনে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করা কল্পনাই থেকে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা চাইছেন, বিধিমালায় কঠোর নিয়মকানুন চালু করে তা বাস্তবায়ন করা হোক। কর্মকর্তাদের স্বজনদের বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের বিষয়ে আগেই সরকারকে জানানো, সম্পদের হিসাব নিশ্চিত করা, রাজনীতি ও সংগঠন করার বিষয়ে কঠোর ও সুস্পষ্ট বিধি যুক্ত করার দাবি তাদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অনেক কর্মকর্তার স্ত্রী-সন্তান বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানে বসবাস করছেন। সন্তানরা বিদেশে ব্যয়বহুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছেন। স্বামী-স্ত্রী কিংবা সন্তান বিদেশে থাকায় তাদের কাছে খুব সহজেই দেশের টাকাপাচারের সুযোগ পাচ্ছেন। আবার চাকরিজীবন শেষে তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। প্রশাসনে এমন উদাহরণ বহু। সুতরাং কর্মকর্তাদের স্বজনদের বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের বিষয়টি কঠিন শর্তের বেড়াজালে ফেলতে হবে।

কর্মকর্তারা জানান, সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ অনুযায়ী কর্মকর্তারা বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারেন না। এই বিধান সংশোধিত আচরণ বিধিমালায়ও যুক্ত করা জরুরি। এ ছাড়া কোনো কর্মকর্তার স্বামী বা স্ত্রী বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে সরকারকে অবহিত করতে হয়; অর্থাৎ পরে জানালেও হয়। কিন্তু বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের আগেই সরকারের অনুমতির বিষয়টি যুক্ত করা জরুরি। এ ছাড়া কেন বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হবে, নাগরিকত্ব নিতে পর্যাপ্ত অর্থের উৎস কী, সেখানে গিয়ে কোন ধরনের কাজ করবেন, ইত্যাদি বিষয় সরকারকে জানানোর বিষয় আচরণবিধিতে যুক্ত করা সময়ের দাবি। ফলে যারা অসৎ উদ্দেশ্যে স্বামী বা স্ত্রী কিংবা সন্তানদের বিদেশি নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করেন, তারা নতুন করে চিন্তাভাবনা করবেন। তাদের অসৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।

কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলেন, অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত হচ্ছেন। তারা বেসরকারি চাকরিজীবীদের সঙ্গেও বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত হচ্ছেন। এটি ভালো লক্ষণ নয়। আচরণবিধিতে এসব বিষয়ে কঠোরতা দরকার।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সাবেক পরামর্শক মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া আমাদের সময়কে বলেন, সরকারি কর্মচারীরা নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। তারা বিভিন্ন দলের নেতার নামে সেøাগান দেন। এটি তাদের আচরণবিধির পুরোপুরি বিরুদ্ধে, যা প্রশাসনে খুবই বাজে নজির সৃষ্টি করছে। সুতরাং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন কোনোভাবেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে না পারেন, তা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিতে কঠোরভাবে যুক্ত করতে হবে। যারা এ বিধি মানবে না, তাদের কী ধরনের শাস্তির আওতায় আনা হবে, তাও স্পষ্ট করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখছি কেউ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হলে কিংবা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে নিয়োগ পেলে সরকারি কর্মচারীরা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ্যে প্রচার করেন। এগুলো ঠিক না। এসব কিছু সংশোধিত আচরণবিধিতে স্পষ্ট করতেই হবে। তিনি বলেন, সরকারি কর্মচারীদের স্বামী-স্ত্রী কিংবা সন্তানরা বিদেশি নাগরিকত্ব লাভের আগেই সরকারের অনুমতির বিষয়টি বিধিতে যুক্ত করতে হবে। এমন কিছু কঠিন শর্ত যুক্ত করতে হবে, যেন সহজেই তাদের স্বামী-স্ত্রী কিংবা সন্তানরা বিদেশি নাগরিকত্ব নিতে না পারে।

সাবেক এ সরকারি কর্মকর্তা বলেন, যেসব কর্মকর্তার স্বজনরা বিদেশি নাগরিকত্ব নেবেন, অবশ্যই তাদের ডাটাবেইজ সরকারের কাছে রাখতে হবে। এই ডাটাবেইজ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা রাখা যেতে পারে। ফলে তারা ডাটাবেইজ ধরে মনিটরিং করতে পারবে। এতে কর্মচারীরা বিদেশে তাদের স্বজনদের কাছে টাকাপাচারের চিন্তা থেকে সরে আসতে পারে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বিদেশে সরকারি কর্মচারীরা সম্পদ পাচার করেন, এটি এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। সুতরাং আচরণবিধি কঠিন করতে হবে।

ফিরোজ মিয়া বলেন, কর্মচারীরা সম্পদের হিসাব দেন না। ফলে চাকরিতে যোগদানের পর তাদের সম্পদ বাড়ল কী কমল, তা জানা যায় না। অবশ্যই প্রতি ৫ বছর পর পর ডিসেম্বরে সম্পদের হিসাব দেওয়ার যে বিধান চালু আছে, সেটি আরও যুগোপযোগী করে সম্পদের হিসাব নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে কর্মচারীদের স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সম্পদের হিসাবও নিতে হবে। তা হলে স্বচ্ছতা আসবে।

তিনি বলেন, কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার প্রক্রিয়া ডিজিটাল করা সময়ের দাবি। এমন পদ্ধতি চালু করতে হবে যেন কেউ হিসাব না দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেই কর্মচারীকে চিহ্নিত করা যায়। এতে সবাই হিসাব দিতে বাধ্য থাকবে। এ ছাড়া সম্পদের হিসাব না দিলে কী শাস্তি হবে, তাও নির্দিষ্ট করতে হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিধি অনুবিভাগ) আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি।’ কর্মকর্তাদের স্বজনদের বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করে নতুন শর্ত যুক্ত করা যায় কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আসলে এটি একটু কঠিন।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ধরুন, আপনার স্ত্রী বিদেশে তার কোনো স্বজনের কাছে স্থায়ী হতে চায়। তা হলে কি আপনার প্রতিষ্ঠান তাতে বাধা দিতে পারবে? পারবে না। এ ক্ষেত্রে হয়তো কিছু শর্ত যুক্ত করতে পারবে। আমরাও হয়তো আপনাদের পরামর্শ বিবেচনায় নিতে পারব।’

সরকারি কর্মচারীরা বিদেশে টাকাপাচার করেন- এমন অভিযোগ বহু পুরনো। গত ১৯ নভেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন এ বিষয়ে এক বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা রাজনীতিকদের চেয়ে বিদেশে বেশি টাকাপাচার করেন। মোমেন বলেন, কানাডার টরন্টোতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সম্পর্কে গোপনে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। আমার ধারণা ছিল রাজনীতিকদের সংখ্যা বেশি হবে; কিন্তু যে তথ্য এসেছে, তাতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে। তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানেই থাকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে ২৮টি কেস এসেছে। এর মধ্যে রাজনীতিক হলেন চারজন। তৈরি পোশাকশিল্পের কিছু ব্যবসায়ীও রয়েছেন। তবে সরকারি কর্মকর্তাদের সংখ্যাই বেশি। তবে এটি সামগ্রিক তথ্য নয়। আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করছি। শুধু কানাডা নয়, মালয়েশিয়াতেও একই অবস্থা।’

বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশও চাইছেন বিদেশে টাকাপাচার বন্ধ হোক। কিন্তু কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা বিদেশে অবস্থান ও বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ পাওয়ায় টাকাপাচার বন্ধ করা কঠিন। আবার স্বজনদের বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণে সরকার বাধাও দিতে পারে না।

বর্তমান আচরণ বিধিমালায় বলা আছে- ‘কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে কোনো বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করিতে পারিবেন না। যদি কোনো সরকারি কর্মচারীর স্বামী বা স্ত্রী বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, তাহা হইলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী বিষয়টি সরকারকে লিখিতভাবে অবহিত করিবেন।’

কর্মকর্তারা বলেন, সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৪০ ধারামতে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করিতে পারিবেন না’ ধারাটি সংশোধিত বিধিমালায় যুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যরা বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের আগে অবশ্যই সরকারকে জানাতে হবে- এমন নিয়ম বিধিমালায় যুক্ত করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ‘সৎ’ কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য- পরিবারের সদস্যরা বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের আগেই সরকারের অনুমতির বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে অসৎ উদ্দেশ্যে অর্থাৎ বিদেশে টাকাপাচারের উদ্দেশ্যে বিদেশি নাগরিকত্ব নেওয়া থেকে হয়তো সরে আসবে। কারণ তখন তাকে সরকারের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। এতে করে অনেকেরই বিদেশি নাগরিকত্বের বিষয়টি ঝুলে যাবে। ফলে বিদেশে টাকাপাচারের ঝুঁকিও কমে আসবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877