বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১০:৩১ পূর্বাহ্ন

পাওয়া না পাওয়ার ২০২১

পাওয়া না পাওয়ার ২০২১

স্বদেশ ডেস্ক:

২০২১ চলে গেল কিন্তু তার ছাপ রেখে গেল পাওয়া না পাওয়ায়। এখনো করোনা সংক্রমণ চলছে। বর্তমানে তার নানান ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা ওমিক্রন। করোনা শুধু রোগশোকই নয়, মানুষের আর্থিক, শারীরিক, মানসিক, এমনকি মানবিক আচরণেও ফেলেছে তার ভয়াল থাবা, আঁচড় ফেলেছে সর্বত্র।

এই মহামারীতে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে, এটা জানার জন্য রোজকার পেপার-পত্রিকাই যথেষ্ট। খুব সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী এলমা চৌধুরী মেঘলার মরদেহের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েকদিন ধরে যেন আর্তনাদ করে ফিরছে। সপ্তাহ না ঘুরতেই চট্টগ্রামে আইনজীবী স্বামীর নির্যাতনের শিকার আরেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। আইনে স্নাতকপড়ুয়া মাহমুদা খানম ওরফে আঁখি স্বামীর নির্যাতনে নিহত হয়েছেন। ঢাকার স্কলাস্টিকা বিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার গাইডেন্স কাউন্সেলর ইভানা লায়লা চৌধুরীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। ইভানার ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বাস্তবে ‘মিসেস ব্যারিস্টার’ হয়েই ব্যারিস্টার স্বামীর ক্রমাগত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে ভেতরে-ভেতরে মরে যেতে যেতে শেষে ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে থেমে যায় তার জীবন। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসেও এলমা, আঁখি কিংবা ইভানাদের প্রাণ হারাতে হচ্ছে। নারীরা অধীন করে রাখার সেই চিরাচরিত লৈঙ্গিক রাজনীতির শিকার। আজও সমাধান হয়নি মুনিয়ার হত্যা না আত্মহত্যারহস্য। আরও বলা যায়, বাংলা সিনেমার অতিপরিচিত মুখ পরীমনি তার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। এ ছাড়া রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার করোনা আক্রান্তের খবরের নিচে হাজারো বাজে মন্তব্য তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। বিশ্ব মা দিবসে নায়িকা ভাবনার ছবির নিচে করা জঘন্য আক্রমণাত্মক মন্তব্যের ঘটনা কে ভুলেছে! ডিজিটাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে নারীকে পতিতালয়ে বিক্রি বা পাচারের ঘটনা তো মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা। কক্সবাজারে বিচ থেকে তুলে নিয়ে গৃহবধূকে গণধর্ষণের ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেই ঘটে গেছে আরও অনেকগুলো ঘটনা। এ ছাড়া ২০২১-এর ৩০ ডিসেম্বর আমাদের সময়ের নিউজ ছিল এ রকম- ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর অর্ধপোড়া লাশ উদ্ধার। আর ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর মতিঝিলে ১৩ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ কনস্টেবলকে গ্রেপ্তার করা হয়। কক্সবাজারে হোটেলে দুদিন ধরে ¯ু‹লছাত্রীকে আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ স্থানীয় যুবক আশিকের বিরুদ্ধে।

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ ও নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ওই সম্মেলনে গত দুই বছরে সারাদেশে হওয়া নারী নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন, দেশে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন এবং রাহাজানির ঘটনা বেড়েছে। তিনি বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ধর্ষণ ছিল ৫ হাজার ৮৪২টি, ২০২০-২১-এ ৭ হাজার ২২২টি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে নারী নির্যাতন ছিল ১২ হাজার ৬৬০টি, ২০২০-২১-এ বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৫৬৭টি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের সমাজের উচ্চশিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণিতে নারীর ওপর সহিংসতা ও নির্দয়তার এ রকম ঘটনা বেড়ে চলেছে। এ ছাড়া কর্মক্ষম পুরুষ করোনায় চাকরি, ব্যবসা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে হতাশা আর ক্ষোভ যেন নারীদের ওপরই মেটাচ্ছে। যার কোনো জরিপ নেই, যার কেউ হিসাব রাখে না। অথচ নারীর প্রতি সহিংসতা অন্য যে কোনো সমস্যার মতোই গুরুত্ব বহন করে। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা বলতে পারি না যে, নারীরা সুরক্ষিত। আমাদের নারীরা রাস্তাঘাটে, অফিসে, এমনকি বাড়িতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের কাজ করতে পারছে- এমন দাবিও আমরা করতে পারি না। উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেন নারীর প্রতি সহিংসতাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ যেন আরেক মহামারী। আইনের মাধ্যমে সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পরও নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা মামলায় এখনো নির্ধারিত ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে না। এত নির্যাতন ও শোষণের মধ্যেও কিন্তু অর্জনের গল্পও আছে। নারীরা হাজারো বাধা-নিষেধের দেয়াল ভেঙে, ঝড়-ঝঞ্ঝা পাড়ি দিয়ে, শাসন-বারণের পাহাড় ডিঙিয়ে, অপমান ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, নিপীড়ন-নির্যাতনকে তুচ্ছ করে অদম্য শক্তিতে বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন এখন বিশ্বের সবার বিস্ময়। যেমন বাংলাদেশের উদ্যোক্তা তানিয়া ওয়াহাব ভারতের মুম্বাইয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল গ্ল্যাম আইকন ফ্যাশন প্যারেডে এক কোটি বিশ লাখ উদ্যোক্তার প্রতিনিধিত্ব করেন এবং দেশে এসে তিনি উই সামিট-২১-এর বিশেষ সম্মাননা’ ইমপ্যাক্টফুল এন্টারপ্রেনার, বেস্ট ইনফ্লুয়েন্সার গ্রহণ করেন। একই পুরস্কার পান আরও একজন নুসরাত আক্তার লোপা, নুসরাত হুর ব্র্যান্ডের স্বত্বাধিকারী। আরও বলি লেদারের ব্যাগ-জুতা কোম্পানি লেদারিনার স্বত্বাধিকারী তাসলিমা মিজির সাফল্য, একজন মফস্বল শহরের গৃহিণী জান্নাতুল ফেরদৌস পোশাক ও খাবার বিক্রি করে লাখপতি। অকুতোভয় সাংবাদিক রোজিনা আক্তারের অনুকরণীয় পদক্ষেপ অথবা বঙ্গমাতা পদকজয়ী মোছা. নুরুন্নাহার বেগম। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গর্ভবতী মায়েদের সেবাদানকারী মিনা রিংসা, লেখক গবেষক নিশাত সুলতানার শিশুদের নিয়ে কাজের গল্প। গোলকিপার্স গ্লোবাল গোল চেঞ্জ মেকার অ্যাওয়ার্ড-২১ পাওয়া তরুণী ফাইরুজ ফাইজা বিথা কিংবা বিশ^সেরা বিজ্ঞানী তনিমা তানিম। দেশীয় ব্র্যান্ডের উদ্যোক্তা আইরিন সরকার নুরী অথবা জামদানি ব্যবসায়ী তানিয়া, ফুড কারভিংয়ের আবিদা, ফারাহ দিবা। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পুরস্কারপ্রাপ্ত ইশরাত নাহের ইরিনা। আকাশজয়ী সাহসী নারী জোহরা মেহজাবিন মন্দিরা, বিউটি এক্সপার্ট আফরোজা পারভিন। এ ছাড়া ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশে গ্রামীণ উন্নয়নে ও নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে। মেয়েশিশুর লেখাপড়াতেও সরকার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী- সেই দেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হবেই, অনেকের এমন মনে হলেও কিন্তু বাস্তবে তা নয়। নারীর ক্ষমতায়ন শুধু গুটিকয়েকজনের শীর্ষপদে আসীন থাকাকে বোঝায় না। ক্ষমতায়ন আসলে একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় নারী তার নিজের জীবনের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পেশা নির্বাচনসহ সব ক্ষেত্রে পরিকল্পনা করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ আর সমঅধিকারের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। সবশেষে বলি নারী তোমার নিজ ক্ষমতায় হয়ে ওঠ ক্ষমতাধর। নিজেকে ভালোবাসো, নিজেই নিজের মূল্যায়ন করো। হয়ে ওঠ সব মঙ্গল সৃষ্টির আধার।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877