স্বদেশ ডেস্ক:
গ্রেফতার ও হয়রানির ভয়ে এখনও আতঙ্ক কাটেনি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার দুই গ্রামের শত শত মানুষের। গ্রাম দুটির কয়েকশ পুরুষ, কিশোর ও তরুণরা গ্রেফতার আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গ্রামে পুরুষশূন্য হওয়ায় নারীরা কাঁধে তুলে নিয়েছেন সংসারের হাল।
অভিভাবকহীন পরিবারগুলোর শিশু ও নারীরা ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। পুরুষরা গ্রামছাড়া হওয়ায় মহিলারা তাদের শিশুসন্তানদের নিয়ে মানবেতর দিনযাপন করছেন।
উপজেলার খনগাঁও ইউপি নির্বাচনের ফল ঘোষণার সময় কেন্দ্রে সংঘর্ষ, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ সময় বিজিবির গুলিতে কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীসহ তিনজন নিহত হন এবং আহত হন গৃহবধূ রহিমা বেগমসহ চারজন। গত ২৮ নভেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঘিডোব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।
ঠাকুরগাঁওয়ের পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ৩ নম্বর খনগাঁও ইউনিয়নে ভোট শেষ হওয়ার পর ফল ঘোষণায় দেরি হচ্ছিল। এ নিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে চশমা প্রতীকে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী নুরুজ্জামানের সমর্থকদের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে প্রিসাইডিং অফিসার নৌকার প্রার্থী শহীদ হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করলে তারা ভোটকেন্দ্র অবরুদ্ধ করেন। ওই সময় প্রিসাইডিং অফিসার বের হয়ে গেলেও একটি কক্ষে তিন পুলিশ সদস্যসহ ১৬ আনসার সদস্য আটকা পড়েন।
পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে যান দায়িত্বরত বিজিবি সদস্যরা। ওই সময় হামলার চেষ্টা হলে আত্মরক্ষার্থে বিজিবি সদস্যরা গুলি ছোড়েন। এ ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া আহত হন চারজন। আহতদের মধ্যে রহিমা বেগম, সবুজ ও রব্বানী এখনও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রহিমার গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তার ডান পা কেটে ফেলা হয়েছে বলে জানান স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী নুরুজ্জামান।
নির্বাচনি সহিংসতার ঘটনায় সদর উপজেলার বেগুনবাড়ি ইউনিয়নের বান্দিগর গ্রামের পান দোকানদার আলী হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ এবং পীরগঞ্জ থানার এসআই আবু হামিদ মণ্ডল ৭০০ জনকে আসামি করে মামলা দেন। এর পর থেকে গ্রেফতার ও পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দুই গ্রামের কয়েকশ মানুষ।
সিড ঘিডোব গ্রামের লাভলী বেগম বলেন, স্বামী হারানোর শোক কাটেনি। এর পর আবার পুলিশের হয়রানি। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। শিশুসন্তান নিয়ে আমরা খুব কষ্টের মধ্যে আছি; তার ওপর আবার মামলা। একই সুরে বলেন বিজিবির গুলিতে নিহত শাহাবুলির স্ত্রী লুৎফা।
স্থানীয়রা জানান, এই দুজনের স্বামী ঢাকায় রিকশা চালাতেন। তাদের পাঠানো টাকায় চলত সংসার। গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাবুলি ও মজাহারুল নিহত হওয়ায় তাদের রেখে যাওয়া ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী পরিজন নিরুপায় হয়ে পড়েছে।
বাবুল নামে এক গুড় ব্যবসায়ী জানান, এখন কৃষির ভরা মৌসুম। এ সময় চাষিরা বাড়িতে থাকতে না পারলে বিশেষ করে গম, ভুট্টা ও বোরো ধান উৎপাদনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হতে পারে। এ ছাড়া রাতেরবেলা ছেলেমেয়ে নিয়ে চুরি-ডাকাতির ভয়ে জেগে থেকে রাত পার করছেন তারা।
মুদির দোকানদার মিনারুল ইসলাম বলেন, সন্ধ্যার পর গ্রামগুলো যেন ভুতুড়ে নগরে পরিণত হয়েছে। পুরুষরা বাড়িছাড়া, আর মেয়েরা ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পায় না।
গত ১ ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে ঘিডোব এলাকা পরিদর্শন করেছেন পুলিশের রংপুর রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমান। পরে ঘিডোব বিদ্যালয় মাঠে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এ সময় এলাকাবাসী অতিরিক্ত ডিআইজির কাছে তাদের কষ্টের কথা তুলে ধরেন। তারা জানান, গ্রেফতারের ভয়ে অনেকেই এলাকা ছেড়েছেন। এলাকাবাসীকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, কোনো নিরপরাধ মানুষকে গ্রেফতার বা হয়রানি করা হবে না। আপনারা নির্ভয়ে নিজ বাসায় থাকতে পারেন। যারা এ ঘটনায় দোষী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কিন্তু এর পরও থেমে নেই পুলিশের অভিযান।
তবে এ বিষয়ে পীরগঞ্জ থানার ওসি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা কোনো রকম আতঙ্ক ও হয়রানি করছি না। মামলাটি তদন্ত করে প্রকৃত যারা দোষী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা।
এ ছাড়া জনসংযোগ বাড়িয়ে সেখানকার লোকজনের ভয়ভীতি কাটাতে প্রেরণামূলক কাজ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।