বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ০৪:১৩ পূর্বাহ্ন

খরচ কেবল বাড়ছেই

স্বদেশ ডেস্ক:

রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা মো. মোস্তাক আহমেদ। করোনা মহামারীতে বেতন কমে যাওয়ায় সংসার চালাতে ঋণের বোঝা বেড়ে যায় এ বেসরকারি চাকরিজীবীর। বর্তমানে করোনার প্রকোপ কমে আসায় তার বেতন স্বাভাবিক হলেও দৈনন্দিন খরচের চাপ বেড়ে গেছে বহুগুণ। তার ওপর ডিজেল ও এলপি গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাসের খরচের বোঝা আরও বেড়েছে। বেতনের ৩০ হাজার টাকা কোনটা রেখে কোনটার পেছনে ব্যয় করবেন, কিছুতেই যেন বুঝে উঠতে পারছেন না মোস্তাক। এর মধ্যে পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা খরচের জন্য ঋণ করতে হচ্ছে তাকে।

ঋণের বোঝা বাড়ছে যাত্রাবাড়ী মোড়ে আখের রস বিক্রেতা রুবেল মিয়ারও। করোনায় দুঃসময় কাটিয়ে একমাত্র সম্বল ডিজেলচালিত মেশিনটি নিয়ে যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন, ঠিক তখনই বাড়ল ডিজেলের দাম। মেশিনের জ্বালানির (দুই লিটার ডিজেল) পেছনে এখন প্রতিদিন ৩০ টাকা করে মাসে ৯০০ টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে তাকে। আয় না বাড়াতে খরচের এ বাড়তি হিসাব নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।

মোস্তাক ও রুবেলের মতো করোনাকালের ধাক্কা এখনো সামলে উঠতে পারেননি অনেকেই। দেশের অর্থনীতি এখনো পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মানুষ মৌলিক চাহিদা কাটছাঁট করে টিকে থাকার লড়াই করছে। মাহামারীর দীর্ঘ অভিঘাতে ভাঙ্গা কোমর নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী যখন একটু সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, ঠিক তখনই বাড়ানো হলো ডিজেল, কেরোসিন ও এলপি গ্যাসের দাম। এর পর একে একে বাস, লঞ্চ, পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। কৃষকের সেচের খরচ, পণ্য উৎপাদন খরচসহ বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়ছে। আগামীতে বিদ্যুতের দামসহ আরও অনেক খরচ বাড়তে পারে বলে জানা গেছে। সবদিক থেকে খরচ কেবল বাড়ছেই, কিন্তু মানুষের আয় বাড়ছে না। জীবনযাত্রার বাড়তি খরচগুলো যেন চেপে ধরছে চারপাশ থেকে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই। এর মধ্যে নতুন করে কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মো. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, করোনাকালে যেসব জনগোষ্ঠী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। করোনাকালে স্বাস্থ্য পরিচর্যার খরচ বাড়ায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আগের তুলনায় অনেক বেশি। এমন পরিস্থিতিতে ডিজেলের মতো অতি প্রয়োজনীয় জ্বালানির দাম বাড়ানোয় স্বল্প ও স্থির আয়ের মানুষের ওপর চাপ অনেক বেড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, ডিজেলের দামের সঙ্গে পরিবহনসহ বিভিন্ন খরচ সমন্বয় করা হলেও তার হার বেশি। অন্যদিকে কৃষিসহ বিভিন্ন শিল্প খাতেও উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে আগামীতে নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন সেবার মূল্যও বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। সরকার হয়তো ঘাটতি বাজেট এড়াতে ভর্তুকি না বাড়িয়ে দাম সমন্বয় করেছে। কিন্তু ভাড়া বৃদ্ধির হারটা সমানুপাতিক হয়নি। এখানে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিতই থেকেছে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, সর্বশেষ বিআইজিডি ও পিপিআরসি জরিপে দেখা গেছে, গত আগস্টে মানুষের আয় করোনার আগের তুলনায় ২৩ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া করোনা মহামারীর শুরু থেকে দেশে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে। এমনিতেই জীবনযাত্রায় সব ধরনের ব্যয় বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ডিজেল, কেরোসিন, এলপি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে যারা দরিদ্র, যারা নতুন দরিদ্র, যারা কোভিড আক্রান্ত অর্থনীতিতে নতুন করে রিকভারির চেষ্টার মধ্যে রয়েছে, তাদের দুর্ভোগ আরও বেড়ে গেছে। জ্বালানির দাম বাড়ানোয় সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রায় চাপ সৃষ্টি হবে। জ্বালানির দাম বাড়ানোর এটা ঠিক সময় নয়।

আমদানি করা ডিজেলের ১৮ শতাংশই ব্যবহার হয় কৃষিতে। নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে শুরু করে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত ডিজেলের চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ। তাই এমন সময় প্রয়োজনীয় জ্বালানির দাম বাড়ায় কৃষকেরও খরচ বেড়ে গেছে। পাবনা সদর থানার উগ্রগড় গ্রামের কৃষক মো. মনিরুজ্জামান মানিক জানান, ডিজেলের দাম বাড়াতে সেচ খরচ এক লাফে অনেক বেড়ে গেছে। প্রতি বিঘা জমিতে সেচপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা খরচ বেড়েছে। আগে বিঘাপ্রতি সেচে মেশিন ভাড়া ৬০০ টাকা ছিল। এখন খরচ হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত। এ হিসেবে সেচ খরচ অন্তত ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেড়েছে। মানিক বলেন, ক্ষেত থেকে বাজারে পণ্য নিতে ডিজেলচালিত ভটভটি গাড়িতে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৩ টাকা ভাড়া বেড়েছে। আগের বস্তাপ্রতি ১২ টাকা ভাড়ার জায়াগায় এখন লাগছে ১৫ টাকা।

গত ৩ নভেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য প্রতি লিটার ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করেছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। পরদিন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম সাড়ে চার টাকা বাড়িয়ে মূসকসহ ১০৯ টাকা ৪২ পয়সা নির্ধারণ করে। বাজারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ১২ কেজি ওজনের একটি সিলিন্ডারে দাম এখন মূসকসহ ১৩১৩ টাকা দাঁড়িয়েছে, অক্টোবরে যা ছিল ১২৫৯ টাকা এবং সেপ্টেম্বরে ১০৩৩ টাকা ছিল। এর পরই মালিক সমিতির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। যদিও রাজধানীর বিভিন্ন রুটে দেখা গেছে ভাড়া ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি রাখা হচ্ছে।

লঞ্চ ভাড়াও ৩৫ শতাংশ বাড়িয়েছে লঞ্চ মালিকরা। ৯ নভেম্বর পাঁচ ধরনের সেবায় ২৩ শতাংশ হারে ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)। এতে আমদানি পণ্যের ব্যয় বেড়েছে। ১৭ নভেম্বর দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী লাইটার জাহাজের ভাড়াও ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। অপরদিকে ধর্মঘট শেষে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করছে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানগুলোও। যার প্রভাব পড়ছে বাজারের পণ্যের দামে।

বাজারে জিনিসপত্রের দামে কোণঠাসা ভোক্তারা সামান্য সবজি খেয়ে দিন পার করবেন, সে উপায়ও নেই। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি এসেও তরিতরকারি কিনে খেতে হচ্ছে চড়া দামে। পণ্য পরিবহনে খরচ অনেকখানি বেড়েছে উল্লেখ করে রাজধানীর কারওয়ানবাজারের পাইকারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ওয়াছি বাণিজ্যালয়ের ব্যবসায়ী মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ার পর থেকে বগুড়া, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজধানীতে পণ্য আমদানিতে ট্রাকভাড়া আড়াই থেকে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি খরচ করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি মো. তোফাজ্জল হোসেনও বলেন, তেল খরচ বাড়লে ভাড়া বাড়বেই। খরচ পোশাতে অনেক মালিক ভাড়া ৩০ শতাংশের মতো বাড়তি রাখছেন শিকার করে তিনি বলেন, তেলের বাড়তি খরচ তো আর মালিক নিজের পকেট থেকে দেবেন না।

এদিকে এলপি গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় রেস্তোরাঁগুলোতেও সকালের নাস্তায় পরোটা-ভাজি থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের খাবারের দাম বেড়েছে। বাংলাদেশ রোস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান জানান, গ্যাসের সিলিন্ডার ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন রেস্তোরাঁ মালিকরা।

বাজারে বছরের ব্যবধানে তেল, চাল, ডাল, চিনি, ডিম, দুধ, মসলাসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। ডিজেলের দাম বাড়ায় অনেক পণ্যের দাম নতুন করে বাড়ছে। বাড়ছে আমদানিনির্ভর পণ্যের দামও। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবও বলছে, বছরের ব্যবধানে কেজিপ্রতি সরু চাল ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ, আটা ১৩ দশমিক ৩৩ থেকে ২৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ, মসুর ডাল (দানাভেদে) ৮ দশমিক ৩৩ থেকে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, চিনি ২৪ শতাংশ, গুঁড়াদুধ ১৩ দশমিক ৮১ শতাংশ দাম বেড়েছে। একই সময়ে প্রতি লিটার খোলা তেলে ৪৬ দশমিক ৯১ শতাংশ, পাম তেলে ৫৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ ও বোতলজাত তেলে ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ দাম বেড়েছে। এ ছাড়া প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ ও ডিম হালিপ্রতি দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

দেশের ভোগ্যপণ্য ব্যবসার অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিত সাহা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামাল ও পণ্যের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম বাড়বে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্য উৎপাদন ও বিপণনেও খরচ বাড়ছে, যার প্রভাব দামের ওপরেও পড়বে। টিকে থাকার জন্যই দাম বাড়াতে হবে ব্যবসায়ীদের।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন আমাদের সময়কে বলেন, ‘মূল্য নির্ধারণ করার মেকানিজমে আমরা বৈজ্ঞানিক কোনো মেথড দেখি না। আমরা যদি আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকি, তা হলে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন মূল্য কম থাকে, তখন সেটার সুফল কেন জনগণ পায় না? আমাদের প্রাইস মেকানিজমকে ঠিক করার প্রয়োজন রয়েছে।’

ড. ফাহমিদা আরও বলেন, ‘তেলের ওপর বিভিন্ন ধরনের শুল্ক কর রয়েছে। সেখান থেকে কোনো একটি শুল্ক প্রত্যাহার করে ভর্তুকি হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা ধরলে বছরে ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া খুব কঠিন বিষয় বলে মনে তো হয় না।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, ভোগ্যপণ্যের সব ‘ইন্টারমিডিয়েট গুডসের’ উৎপাদন ব্যয়ও ৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। খাদ্য পণ্য উৎপাদনে ব্যয় ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। দুগ্ধজাত পণ্যেও ব্যয় ১ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছে। জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম কম ছিল তখন দেশের বাজারে বেশি দামে তেল বিক্রি করে ৪৩ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে বিপিসি। সুতরাং দাম না বাড়িয়ে ভর্তুকি দেওয়া যেত। জ্বালানির দাম যে হারে বেড়েছে, তার থেকে বেশি হারে পরিবহন ভাড়া সমন্বয় করা হয়েছে। তা ছাড়া ডিজেলের দাম বাড়ায় কাঁচামাল ও উৎপাদন খরচ যা বেড়েছে, বাজারে দাম তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। সরকার বাজারে সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার উদ্যোগ নিলে এমনটি হতো না।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877