শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০১:২৯ অপরাহ্ন

তিক্ত অভিজ্ঞতায় আর ঝুড়ি ভরতে চায় না আ.লীগ

তিক্ত অভিজ্ঞতায় আর ঝুড়ি ভরতে চায় না আ.লীগ

স্বদেশ ডেস্ক:

ইউনিয়ন পরিষদের গত দুই ধাপের নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সরে এসে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে চায় আওয়ামী লীগ। দলীয় হাইকমান্ডের কাছে জমা হওয়া সাংগঠনিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে একটি সুন্দর নির্বাচন করতে চায় দলটি। প্রতিবেদনে সহিংসতার কারণ চিহ্নিত করার পাশাপাশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিষয়েও সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। ইউপি নির্বাচনের আগামী ধাপগুলোতে যেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সংঘাতে না জড়ায়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, প্রার্থীদের বিষয়ে প্রতিবেদনে সরেজমিন যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা দলকে হতাশ করেছে। সে কারণে আগামী নির্বাচনগুলোতে যেন দলের কোনো নেতাকর্মী সহিংসতায় না জড়ায়, সে বিষয়ে তৃণমূলেও ইতোমধ্যে হুশিয়ারি বার্তা পাঠানো হয়েছে। দলের একজন জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আমাদের সময়কে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে ভোটারদের মন জয় করে দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করার নির্দেশনা আমরা তৃণমূলে দিয়েছি। ইউপি নির্বাচনে গত দুই ধাপে যেসব নেতা ও এমপি বিদ্রোহীদের মদদ দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগামী নির্বাচনে কেউ বিদ্রোহী হলে বা বিদ্রোহীদের মদদ দিলে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন পরিচালনার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশন যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।’

দলের সাংগঠনিক প্রতিবেদনের তথ্য এবং আমাদের সময়ের ব্যুরো অফিস, নিজস্ব প্রতিবেদক ও আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে দেখা যায়, তিন ধাপের নির্বাচনী সহিংসতায় ৪৭ জনের প্রাণ গেছে। এদের আওয়ামী লীগ থেকে মনোনীত প্রার্থীর ১৬, বিদ্রোহী প্রার্থীর ১১ ও ৩ জন বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচিত। বাকি ১৭ জন সাধারণ ভোটার। সহিংসতার ঘটনায় ১৩ জেলায় মামলা হয়েছে ১৭টি। আসামি ৯ শতাধিক। গ্রেপ্তার মাত্র ৬২ জন। প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে ৩১ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী, নৌকায় ১৪৮ জন, স্বতন্ত্র ৪৯ জন। দ্বিতীয় ধাপে ৪৮৬ জন নৌকা, স্বতন্ত্র ৩৩০ জন ও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৮১ জন জয়ী হন।

জানা গেছে, প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৫, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ৩০ ও তৃতীয় ধাপের নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় ২ জন নিহত হয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপে নিহত ৩০ জনের মধ্যে নরসিংদীতে ৯, কক্সবাজারে ৫, মাগুরায় ৪, মেহেরপুরে ২, গাইবান্ধায় ২, রাঙামাটিতে ২, কুমিল্লায় ১, চট্টগ্রাম ১, মাদারীপুর ১, ফরিদপুর ১, বরিশালে ১ ও যশোরে ১ জন নিহত হয়েছেন। তৃতীয় ধাপে সহিংসতায় একজন নওগাঁয় ও একজন যশোরে নিহত হন।

আমাদের সময়ের প্রতিনিধিরা জানান, নরসিংদীতে নির্বাচনের আগে ও পরে ৩ দফায় সংঘর্ষে ৯ জন নিহত হন। সবাই আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক। এর মধ্যে দলীয় ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক রয়েছেন। সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সহিংসতায় ৯ জন নিহতের ঘটনায় চারটি মামলায় আসামি ৩ শতাধিক। কিন্তু গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র ১৭ জন। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ‘মূল আসামি’ নেই বললেই চলে। চর এলাকায় হওয়ায় আসামিরা অভিযানের আগেই অন্য চরে চলে যায়। এ কারণেই আসামি গ্রেপ্তারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই বলে দাবি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

কক্সবাজারে নির্বাচনী সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ৫ জন নিহত হন। নিহতরা সবাই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থক। এদের মধ্যে জেলা শ্রমিক লীগের এক নেতা রয়েছেন। নিহতদের মধ্যে কক্সবাজার সদরে ২, মহেশখালীতে ২ ও কুতুবদিয়ায় ১ জন নিহত হন। কক্সবাজার সদরে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ২ জন নিহত হন। মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় আওয়ামী লীগের দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী ও দলটির বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ৫ জন নিহতের ঘটনায় ৫টি মামলায় দুই শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বেশিরভাগই ধরা পড়েন র‌্যাবের হাতে। অন্যদের স্থানীয়রা আটক করে পুলিশে দেয়। পুলিশ সহিংসতার কোনো আসামি গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

মাগুরায় সদস্য (মেম্বার) প্রার্থীদের মধ্যে সহিংসতায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে চারজন নিহত হন। এ ঘটনায় ২টি মামলায় আসামি করা হয় ১২০ জনকে। গ্রেপ্তার মাত্র ১১ জন। তারা সদ্য আওয়ামী লীগে যোগদানকারী। নিহতদের রাজনৈতিক পরিচয় নেই।

পিরোজপুরে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ও দলটির বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন পিরোজপুর পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল মাহবুব শুভ। এ ঘটনায় দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা হয়। প্রধান আসামি বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী। তাকেসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

মেহেরপুরের গাংনীতে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ২ সহোদর খুন হন। এ ঘটনায় একটি মামলায় ৬ জনকে আসামি করা হয়। কিন্তু কোনো আসামিই ধরা পড়েনি। দুজনই আওয়ামী লীগ সমর্থক।

গাইবান্ধা সদরে সহিংসতায় প্রতিপক্ষের দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে ২ বিএনপি সমর্থক নিহত হন। তাদের একজন নবনির্বাচিত ইউপি মেম্বার। এসব ঘটনায় সদর থানায় মামলা হয়েছে ২টি। ইউপি মেম্বার হত্যা মামলার প্রধান আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে।

রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলায় সহিংসতায় আওয়ামী লীগের দুই নেতাকর্মী নিহত হন। একজন ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী, অন্যজন ইউপি মেম্বার। ২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা গুলি করে হত্যা করে। আর আওয়ামী লীগ ও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ইউপি সদস্য। দুই ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে ১১ জন।

কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় সহিংসতায় দুজনের মৃত্যু হয়। একজন গুলিতে নিহত হন। তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী। আওয়ামী লীগ ও দলটির বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে যান। অন্যজন প্রিসাইডিং অফিসার। সহিংসতার সময় তিনি স্ট্রোক করেন। এ ঘটনায় একটি মামলা হয়। আসামি অজ্ঞাত। গ্রেপ্তার হয়নি কেউ।

নওগাঁর মান্দায় সহিংসতায় স্বতন্ত্র (বিএনপি) প্রার্থীর কর্মী এমরান হোসেন রানা নিহতের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এতে উপজেলার গণেশপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী হানিফ উদ্দিন ম-লকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।

ফটিকছড়িতে ইউপি নির্বাচনে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতায় দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে একজন নিহত হন। এ ঘটনায় ৮ জনকে আসামি করে মামলা হয়। পুলিশ ২ জনকে গ্রেপ্তার করে।

মাদারীপুরের কালকিনিতে নির্বাচনী সহিংসতা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর এক কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে যান। ফরিদপুরের সালথায় আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ও দলটির বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন খুন হন। তিনি বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী ছিলেন। এ ঘটনায় মামলা হলেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

যশোরের শার্শা উপজেলায় আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ১ জন নিহত হন। এ ছাড়া চৌগাছায় দুই পরাজিত মেম্বার প্রার্থীর বিরোধের জেরে মারা যান এক রাজমিস্ত্রি। বরিশালের আগৈলঝাড়ায় নির্বাচনী সহিংসতায় আহত এক ভ্যানচালক ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। এ ঘটনায় একটি মামলায় ৫৫ জনকে আসামি করা হয়। পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ৩ জনকে।

আরও ৩ জেলায় সহিংসতা

পিরোজপুর : কাউখালী উপজেলার চিড়াপাড়া-পারসাতুরিয়া ইউপি নির্বাচনী সহিংসতায় আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহামুদ খান খোকনের ভাইসহ ৭ জন আহত হন। গুরুতর আহত নৌকার সমর্থক মওদুদ খান, মামুন মোড়ল ও মিন্টু তালুকদারকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী বজলুর রহমান নান্নু ও তার সমর্থকরা নির্বাচনী সভা শেষে ফিরছিলেন। চিরাপাড়া টেম্পো স্ট্যান্ডে তারা নৌকার সমর্থকদের মুখোমুখি হন। এক পর্যায়ে নান্নুর সমর্থকরা তাদের ওপর হামলা চালায়।

মির্জাগঞ্জ (পটুয়াখালী) : উপজেলার মজিদবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. গোলাম সরোয়ার (কিচলু) ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. সহিদুল্লাহর সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। গত শনিবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর একাধিক নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করে। এর দুই দিন আগে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে কমপক্ষে ৬ জন আহত হন।

রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) : রূপগঞ্জে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী মেম্বার মানিক মিয়ার সমর্থকদের সঙ্গে পরাজিত মেম্বার প্রার্থী মহিউদ্দিনের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় একটি অফিসে হামলা চালানো হয়। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ৮ জন আহত হন। গত শনিবার রাতে উপজেলার বড়ালু পাড়াগাঁও এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

চৌগাছা (যশোর) : চৌগাছায় নির্বাচনী গোলযোগের সময় শওকত আলী খান নামের এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে। গতকাল নিহতের বড় ছেলে জুয়েল রানা চৌগাছা থানায় মামলাটি করেন। মামলায় পুলিশ হেফাজতে থাকা গ্রামের নারী ইউপি সদস্য প্রার্থী পলি পারভীন ও তার ছেলে ইমরান হোসেনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে হাজতে পাঠানো হয়েছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877