বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০৮:৪৭ অপরাহ্ন

বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক ব্যাধি

বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক ব্যাধি

ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম :

বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক অভিশাপ। বাল্যবিয়ের শীর্ষে ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ প্রবণতা ঠেকাতে বাংলাদেশ এখনো কার্যকর সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। প্রথমত এবং প্রধানত জনসচেতনতার অভাব এর প্রধান কারণ। এ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার মধ্যে এ ব্যাপারে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। আইনত মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে বাল্যবিয়ের আওতায় পড়ে। বিয়ে একটি বৈধ পদ্ধতি বটে। তবে অভিজ্ঞতায় বলে, বাল্যবিয়ে একটি মেয়েকে সুরক্ষা দেয় না বরং তার শৈশব ও কৈশোরের বেশ কিছু সম্ভাবনাকে কেড়ে নেয়।

বাল্যবিয়ের প্রবণতা শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেশি। গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা রজঃশীলা হওয়ার আগেই তাদের অনেককেই বিয়ে দেয়া হয়। যাদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। অভিভাবকরা রজঃশীলা মেয়েকে ঘরে রাখতে ভয় পায়; বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতার জন্য। বাল্যবিয়ের হার নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি হিসাবে কিছু তারতম্য আছে, কিন্তু সত্য হলো – বাল্যবিয়ের হার কার্যকরভাবে কমছে না। বাংলাদেশের জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ (বিডিএইচএস) অনুযায়ী, ১৮ বছরের আগেই দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বিডিএইচএসের আর একটি হিসাবে উল্লেøখ করা হয়েছে, ২০০৭ এবং ২০১১ সালে বাল্যবিয়ের হার ৬৫ শতাংশ ছিল। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপ বলছে, করোনাকালে বাল্যবিয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে।

২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২১টি জেলার ৮৪টি উপজেলায় জরিপ চালিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ২১ জেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরগুনায় এক হাজার ৫১২, কুড়িগ্রামে এক হাজার ২৭২ ও নীলফামারীতে এক হাজার ২২২টি বাল্যবিয়ে হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়।

১৯২৯ সালে প্রথম বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ আইন প্রণোয়ন করা হয়। উল্লিখিত বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই ব্যবস্থাপনার দায়ে ব্যবস্থাপকদের এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকার অর্থদণ্ডের বিধান ছিল; কিন্তু তার বাস্তব প্রয়োগ না থাকায় বাল্যবিয়ে বন্ধ হয়নি। তৎকালীন হিন্দু সমাজে মেয়েদের ঋতুমতী হওয়ার আগেই বিয়ে দেয়া হতো। তা না করলে সমাজে মান থাকত না। মুসলিম সমাজেও মেয়েরা রজঃশীলা হওয়ার সাথে সাথে বিয়ে দেয়া হতো। এ দু’টি প্রবণতা ঠেকাতে এমন আইন করা হয়েছিল; কিন্তু দেখা গেল, আইন কার্যকর হওয়ার আগেই তৎকালীন সারা বাংলাদেশে আর কোনো অবিবাহিত মেয়ে থাকল না। পাঁচ বছর বয়সী মেয়েদের রাতারাতি বিয়ে হয়ে গেল। অভিভাবকরা ভয় পাচ্ছিলেন মেয়েরা বুড়িয়ে যাবে, তাদের আর বিয়ে দেয়া যাবে না। তখন মেয়েদের পড়ালেখা ও কর্মশীলা হওয়ার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত ছিল।

করোনাকালীন বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার কিছু অন্তর্নিহিত কারণ রয়েছে। যেমন, চাকরি ও আয়রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়া। চাকরিহারা ছেলেদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রয়োজন ছিল। বিয়ে করলে কিছু উপঢৌকন পাওয়া যাবে। অনেকে লোভের বশবর্তী হয়ে বিয়ে করেছেন। অপর দিকে মেয়েদের মা-বাবারা চিন্তা করেছেন, করোনা কতদিন থাকে তা আমরা জানি না। সুতরাং যখন একটা সম্পর্ক এসেছে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিই। সামাজিক অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে বাল্যবিয়ের ঘটনা বেড়েছে, এ কথা বলা যায়।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাল্যবিয়ে হলে অসুবিধা কোথায়? চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একজন মেয়ের শারীরিক ও মানসিক পরিপূর্ণতা আসে ১৮ বছর বয়সে। তার আগে শারীরিক ও মানসিক পরিপক্বতা ও সন্তান ধারণের দৈহিক সক্ষমতা গড়ে ওঠে না। অল্প বয়সে মা হওয়ার কারণে তারা বিভিন্ন ধরনের রোগে ভোগে, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। এমনকি যে সন্তান জন্ম দিচ্ছে সে সন্তানও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে জন্মগ্রহণ করে। ভবিষ্যতের সুস্থ জাতির জন্য বাল্যবিয়ের প্রবণতা ঠেকানো জরুরি। না হলে ভবিষ্যতে জাতির বিরাট একটি অংশ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকার বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন প্রবর্তনসহ মেয়েদের শিক্ষাবৃত্তি দিচ্ছে, যেন মেয়েরা লেখাপড়া করে। এ উদ্যোগ অভিভাবকদের উৎসাহ জুগিয়েছে। কিন্তু করোকালীন প্রণোদনা সাময়িকভাবে বন্ধ থাকায় অভিভাবকরা আতঙ্কিত হয়ে দ্রুত মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী সাহেবরা) বড় ভ‚মিকা পালন করতে পারেন। ভুয়া জন্মসনদ আর কাজীর অনৈতিক সাহায্য নিয়ে কিছু অভিভাবক অনায়াসে মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন। মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক কি না তা কাজী সাহেবরা বুঝতে পারেন, স্থানীয় সামাজিক নেতারা তা বুঝতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে তাদের উদ্যোগের অভাব রয়েছে। মিডিয়া, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং মেম্বাররা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বড় ভ‚মিকা রাখতে পারেন।
এনজিওগুলো বাল্যবিয়ে ঠেকানোর ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় কাজ করছে। তাদের উদ্যোগে আয়োজিত বহু বাল্যবিয়ে ভেঙে দেয়া হয়েছে। মেয়ের বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি দেশের সুশীলসমাজ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক নেতা ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার উদ্যোগী ভূমিকাই পারে এ গ্লানি থেকে নারী জাতিকে মুক্তি দিতে।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ রিশেষজ্ঞ

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877