রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১৩ অপরাহ্ন

আবাসিকে গ্যাস সংযোগ, বৈধ বন্ধ অবৈধ খোলা!

আবাসিকে গ্যাস সংযোগ, বৈধ বন্ধ অবৈধ খোলা!

স্বদেশ ডেস্ক;

আবাসিক গ্যাস সংযোগে গ্রাহকের পাশে দাঁড়াতে পারছে না তিতাসসহ ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। জনমানুষের চাহিদা থাকার পরও দীর্ঘদিন ধরে আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে রেখেছে সরকার। বৈধ সংযোগ বন্ধ থাকলেও বন্ধ নেই অবৈধ গ্যাস সংযোগ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখন অবৈধ গ্যাস সংযোগের রমরমা ব্যবসা চলছে। বছরের পর বছর ধরে যারা বৈধ সংযোগের অপেক্ষায় ছিলেন, তারাও এখন অবৈধ সংযোগের দিকে ঝুঁকছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে আবাসিক গ্যাস সংযোগের জন্য ডিমান্ড নোটের টাকা জমা দিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছেন ৫৬ হাজার গ্রাহক।

একদিকে তারা সংযোগ পাননি, অন্যদিকে টাকাও ফেরত পাননি। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। চট্টগ্রাম গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি গ্রাহক ঐক্যজোটের সভাপতি আলমগীর নূর ও মহাসচিব একেএম অলিউল্লাহ হক ও সাধারণ গ্রাহক মো. নুরুল আলম গত ৪ অক্টোবর হাইকোর্টে একটি রিট করেন। আবাসিক এলাকায় গ্যাস সংযোগ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ না দিয়ে টাকা ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আবাসিকে গ্যাস সংযোগ দিতে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টিও উঠে আসে।

বর্তমানে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে অভিযান পরিচালনা করলেও অবৈধ সংযোগ দেওয়া অব্যাহত রেখেছে অসাধু লোকজন। এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেওয়া এখন অত্যন্ত সহজ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ প্রদানে একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এসব সিন্ডিকেটকে প্রভাবশালী স্থানীয় মহল সমর্থন দিয়ে আসছে। ফলে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো চাইলেও অবৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধ করতে পারছে না।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো অস্বীকার করলেও বাস্তবতা হলো- ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোর অধিকাংশ বাড়িতে এখন অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে। যাদের আগে একটি বা দুটি গ্যাসের বার্নার অনুমোদন ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা তা বাড়িয়ে নিয়েছেন। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলো যথেষ্ট লোকবলের অভাবে সব বাড়ি বাড়ি গিয়ে এগুলো চেক করতে পারছেন না। অন্যদিকে যাদের চেক করে দেখার দায়িত্ব, তারাও অনেক সময় অবৈধ সুযোগ নিয়ে চলে আসছেন। ফলে অবৈধ গ্যাস ব্যবহার বন্ধ করা বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (তিতাস) দেশের বৃহৎ এলাকা আবাসিক গ্যাস সংযোগ দিয়েছে। তিতাস বর্তমানে তার বিতরণ এলাকায় সাড়ে ২৮ লাখের বেশি গ্রাহকের কাছে আবাসিক গ্যাস সরবরাহ করছে। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা মনে করছেন, বৈধভাবে সাড়ে ২৮ লাখ আবাসিক গ্রাহক থাকলেও অবৈধ গ্রাহকের সংখ্যাও প্রায় সমান।

গত বছরের ডিসেম্বরে জ¦ালানি বিভাগ সিদ্ধান্ত নেয়, আবাসিক খাতে আর কোনো গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে না। ডিমান্ড নোট ইস্যু করা গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্রাহকদের ডিমান্ড নোটের টাকা ফেরত দিতে একটি কমিটি করেছিল। কমিটির দায়িত্ব ছিল সঠিক গ্রাহক চিহ্নিত করে তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা। তবে গত আট মাসেও গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারেনি।

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লা আমদের সময়কে বলেন, ‘আবাসিক গ্যাস সংযোগের বিষয়ে একটি রিটের সংবাদ পত্রিকায় পড়েছি। কাগজপত্র অফিসিয়ালি তিতাস পেলে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা), তিতাসের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমি যখন তিতাসের এমডি ছিলাম, তখন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ গ্রাহকের ডিমান্ড নোটের টাকা পরিশোধ করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করি। কতজন গ্রাহকের ডিমান্ড নোটের টাকা জমা পড়ে ছিল সেটিও চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন তিতাস কর্তৃপক্ষ চাইলেই টাকা ফেরত দেওয়ার কাজটি করতে পারে।

এদিকে আবাসিক গ্যাস সংযোগ চেয়ে আদালতে রিট প্রসঙ্গে জ¦ালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জ¦ালানি সচিব দেশের বাইরে আছেন। তিনি এলে এ রিটের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। তিনি এও বলেন, ‘অবৈধ আবাসিক গ্যাস সংযোগ ব্যাপক আকারে বেড়েছে। মাঝে মধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালালেও সেটি সফল হচ্ছে না। এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ গত বছরের দিকে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল মন্ত্রণালয়ে। সেখানে বলা হয়েছে- গ্যাস সংযোগ চালু রাখলেই অবৈধ সংযোগ কমে আসবে। জ¦ালানি বিভাগও সেই প্রস্তাব অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন চায়। তবে সেটির অনুমোদন হয়নি।’

২০১৯ সালের ২১ মে গ্যাস সংযোগ বন্ধ নিয়ে এক আদেশ জারি করে সরকার। সেই আদেশে আবাসিক, সিএনজি ও বাণিজ্যিক স্থাপনায় নতুন গ্যাস সংযোগ না দিতে নির্দেশনা জারি করা হয়। ওই সময়ের আগে যারা ডিমান্ড নোটের টাকা জমা দিয়েছিলেন, তাদের টাকা ফেরত দিতে নির্দেশনা দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।

তিতাস সূত্র জানা যায়, নতুন গ্যাস সংযোগের জন্য সংস্থাটির কাছে ৫৬ হাজারের বেশি গ্রাহকের ডিমান্ড নোটের টাকা জমা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ডিসেম্বরে জ্বালানি বিভাগ এক আদেশে তিতাসকে দুটি বিষয়ে নির্দেশনা দেয়। প্রথমটি হলো- যারা ডিমান্ড নোট পেয়ে টাকা জমা দেয়নি, তাদের আবেদন বাতিল করা। দ্বিতীয়ত যারা টাকা জমা দিয়েছেন দ্রুত পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাদের সে টাকা ফেরত দেওয়া।

গত ২৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের মাসিক সমন্বয়সভায় সিদ্ধান্ত হয়- আবাসিকে গ্যাস সংযোগ আর চালুর সুযোগ না থাকায় ডিমান্ড নোটের বিপরীতে যারা টাকা জমা দিয়েছিলেন, তাদের ক্রস চেকের মাধ্যমে টাকা ফেরত দেওয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে চট্টগ্রাম গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি গ্রাহক ঐক্যজোটের সভাপতি আলমগীর নূর ও মহাসচিব একেএম অলিউল্লাহ হক ও সাধারণ গ্রাহক মো. নুরুল আলম গত ৪ অক্টোবর হাইকোর্টে রিট করেন।

রিটকারীদের আইনজীবী ওয়াজি উল্লাহ বলেন, আইনে বলা আছে- ডিমান্ড নোটের (চাহিদাপত্র) বিপরীতে গ্যাস সংযোগের জন্য টাকা জমা নেওয়া হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের গ্যাস সংযোগ দিতে সরকার বাধ্য। কিন্তু টাকা জমা নেওয়ার পর নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও তাদের গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়নি। বরং তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যা আইনসম্মত নয়। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে আমরা রিট করেছি।

রান্নার গ্যাস নিয়ে বৈষম্য

রান্নার গ্যাস নিয়ে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন ব্যবহারকারীরা। পাইপলাইনে গ্যাস সংযোগে মাসে বিল গুনতে হয় ৯৭৫ টাকা। এই বিল দিয়ে গ্রাহক ইচ্ছেমতো পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করতে পারছেন। অন্যদিকে একটি সাড়ে ১২ কেজির এলপিজির বোতল গ্যাসের দাম ১২০০ টাকার ওপরে। এই গ্যাস দিয়ে একটি পরিবারের অর্ধেক মাসও চলছে না। ফলে একটি পরিবারের যদি দুটি বোতল লাগে, তাদের খরচ পড়ছে ২৫০০ টাকার মতো। আবার পাইপলাইনের গ্যাসে যাদের মিটার রয়েছে, তাদের খরচ পড়ছে মাসে সাড়ে চার থেকে পাচশ টাকা। ফলে সামগ্রিক বিবেচনায় বোতলজাত গ্যাসের দাম বেশি এবং টানাহেঁচড়ায় জটিলতার কারণে মানুষ পাইপলাইনের গ্যাস সংযোগপ্রত্যাশী। কিন্তু বৈধভাবে সংযোগ নেওয়ার সুযোগ না থাকায় মানুষ ঝুঁকছেন অবৈধ সংযোগে।

প্রসঙ্গত দেশে গ্যাস সংকটের প্রেক্ষাপটে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়। এর পর ২০১৩ সালের শেষের দিকে আবারও আবাসিকের সংযোগ চালু করা হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের পর আবারও জ্বালানি বিভাগ থেকে অলিখিতভাবে বিতরণ কোম্পানিকে আবাসিকের নতুন আবেদন নিতে নিষেধ করে দেওয়া হয়। পরে ২০১৯ সালে লিখিতভাবে আবাসিক সংযোগ স্থগিত রাখার আদেশ জারি করা হয়। কিন্তু ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত গত আট বছরে তিতাসসহ অন্য বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে ডিমান্ড নোটের টাকা জমা নিয়েছে। ফলে এ সময়ের মধ্যে ডিমান্ড নোটের টাকা জমা দেওয়া গ্রাহকদের টাকা দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877