শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৮:২৩ অপরাহ্ন

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ‘সিংক হোল’

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ‘সিংক হোল’

শাহরীন তাবাসসুম :

আমরা বন্যা, সাইক্লোন, খরা, ভূমিকম্প, লবণাক্ততাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে পরিচিত। এরকমই একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের নাম সিংক হোল; যা তুরস্ক, ইসরাইল এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও দেখা দিয়েছে ব্যাপক হারে।

কোনো একটি স্থানের ভূমি হঠাৎ অথবা ধাপে ধাপে ধসে গিয়ে তৈরি হওয়া গর্তকে ‘সিংক হোল’ বলা হয়। ভূগর্ভে থাকা পানি বা শিলা অতিরিক্ত উত্তোলনে তৈরি হয় ‘সিংক হোল’। এগুলো সাধারণত কয়েক ফুট থেকে কয়েক শ’ একর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। গভীরতা এক থেকে ২০০০ ফুট পর্যন্ত হয়। দেখতে অনেকটা অগভীর বাটি বা বোলের মতো। কিছু সিংক হোলে পানি জমে পুকুর বা ডোবা তৈরি হয়। অনেক দেশেই এ হোল বা গর্ত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে ৩০০টিরও বেশি সিংক হোল তৈরি হতে দেখা গেছে, যা আপনা আপনি সৃষ্ট। একটি সিংক হোল তৈরি হতে কয়েক দশক এমনকি শতাব্দী পর্যন্ত সময় লাগে। সম্প্রতি এর হার বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাবেই সিংক হোল দুর্যোগের সৃষ্টি। এর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে ভূগরর্ভে পানি ও খনিজের অতিরিক্ত উত্তোলনই প্রধানত দায়ী।

সিংক হোল সাধারণত দু’টি প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে- ১. বিভিন্ন আকরিক শিলার রাসায়নিক ভাঙন থেকে এবং ২. ‘সাফোসন প্রসেস’ যেখানে পানি কিংবা অন্য কোনো তরল পদার্থে ভূগরের্ভ মাটি বা শিলা ক্ষয় হয়ে সরে গেলে। এটি প্রকৃতিতে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া গর্ত। বৃষ্টির সময় মাটির উপরিতলের পানি ফিল্টার হয়ে সাব-সারফেসে জমা হয় যাকে অ্যাকুইফার বলা হয়। অ্যাকুইফারে জমে থাকা পানি সেচকাজ, পান করা, গৃহস্থালির কাজ ইত্যাদির জন্য মেশিনের সাহায্যে উত্তোলন করে থাকি আমরা। কিছু ক্ষেত্রে আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি উত্তোলন করে অপচয় করি। অতিরিক্ত উত্তোলনে ভূমিতে অসামঞ্জস্য তৈরি হয়ে ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হয়। তখন উপরিভাগে ভূমিধস হয়ে বড় ধরনের গর্ত তৈরি হয়ে থাকে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, শুধু পানি উত্তোলনেই নয়, মাটির অভ্যন্তরের কঠিন শিলা উত্তোলনেও বাড়ছে সিংক হোলের সংখ্যা। যেসব এলাকায় মাটির অভ্যন্তরে কঠিন শিলা রয়েছে; সেখানে এসব উত্তোলনের হারও বেশি। সেখানে লবণ, চুনাপাথর, কপার ও জিপসামের মতো খনিজ স্তর থাকে। এসব খনিজপদার্থ অপরিকল্পিত ও অতিরিক্ত উত্তোলনে মাটির অভ্যন্তরে ফাঁপা জায়গা তৈরি হয়ে থাকে। এরপর সেই এলাকার মাটির উপরিতল নিজের ভারেই ধসে তৈরি হয় সিংক হোল। এ ছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, তীব্র খরা, মাটি ক্ষয়, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, মিথেন গ্যাসের প্রভাব ইত্যাদি কারণেও সিংক হোল তৈরি হতে পারে। শহরে সিংক হোল বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত ভূগরর্ভে সুয়ারেজ লাইন বা মাটির নিচের নির্মাণকাজকে মনে করা হচ্ছে।

সিংক হোলকে ভূমিধস বা ল্যান্ডস্লাইড মনে করা হলেও দু’টি ভিন্ন প্রকৃতির। সিংক হোল প্রকৃতিতে নতুন কোনো বিপর্যয় নয়। তবে এক মাসের মধ্যে পাঁচটি দেশে এ গর্ত তৈরি হওয়ায় ভূতত্ত¡বিদরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সিংক হোল নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগে রয়েছে তুরস্ক। দেশটিতে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সিংক হোল দেখা গেছে। ২০২০ সালে সেখানে সিংক হোলের সংখ্যা ছিল ৩৬০, বর্তমানে বেড়ে ৬০০-তে উন্নীত হয়েছে। এর জন্য দেশটির পানি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। ১০-১৫ বছরের খরাজনিত কারণে গমের আবাদে সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে কৃষকদের। আগে যেখানে বছরে দুইবার সেচ দিতে হতো; সেখানে খরার কারণে এখন বছরে পাঁচ থেকে ছয়বার দিতে হচ্ছে। কোটি কোটি লিটার উত্তোলনে পানির স্তর নিচে নেমে তৈরি হচ্ছে দানবাকার গর্তগুলো। এ অবস্থা থাকলে অসংখ্য সিংক হোলে তুরস্ক আরো একটি বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাবে, তখন দেখা দিতে পারে দুর্ভিক্ষ।

আরো কিছু দেশে সিংক হোলের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক সিংক হোল মিসরের কায়রোতে; যা ১৩৩ মিটার গভীর আর ৮০ কিলোমিটার লম্বা এবং ১২০ কিলোমিটার প্রশস্ত। চিলিতে দুই হাজার ৭৯০ ফুট গভীর সিংক হোল চুকুইচামাতা সৃষ্টি হয়েছিল ১৯১০ সালে। চীনের চংকিংয়ে অবস্থিত জিয়াওজাই তিয়ানকেং নামের সিংক হোলটি ৬৬২ মিটার গভীর আর ৬২৬ মিটার প্রশস্ত। রাশিয়ার সাইবেরিয়াতে রয়েছে এক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে সিংক হোল। এক ভূমিকম্পের পর ক্রোয়েশিয়ায় শতাধিক সিংক হোলের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও ইতালি, মেক্সিকো, ইসরাইল এমনকি ভারতেও তৈরি হয়েছে দানবাকৃতির গর্ত ‘সিংক হোল’।

দেখা গেছে, অনেক সময় সিংক হোল হঠাৎ তৈরি হয় না। বেশ কয়েক মাস এমনকি বছরও লেগে যায়। কিছু ক্ষেত্রে গর্তগুলো কোনো রকম পূর্ব সঙ্কেত ছাড়াই তৈরি হয়। গবেষকরা গর্তগুলোর প্রকৃত গঠন, প্রকৃতি ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছেন।

সিংক হোল তৈরি হওয়ার আগে প্রকৃতিতে কিছু পরিবর্তন দৃষ্টিগোচর হয়। দালান বা বাড়ির ফাউন্ডেশনে বা বাড়ির ভেতরে গভীর সিংক হোল সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব লক্ষণ। ভূমিতে ফাটল দেখা দিলেও যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া উচিত। গাছপালা মরে যাওয়া, শুকিয়ে যাওয়া বা হঠাৎ করে মাটিতে উপড়ে পড়লেও সেখানে সিংক হোল তৈরি হতে পারে। সিংক হোলের এরিয়া থেকে পানি ও অন্যান্য মৌল সরে যাওয়ায় মাটিতে কোনো গাছ বাঁচতে পারে না। এ ছাড়াও টিউবওয়েল বা ট্যাপের পানি হঠাৎ করেই অস্বচ্ছ হলেও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ বিভিন্ন মিনারেলের সাথে মাটি ও পানি দ্রবীভূত হয়ে ঘোলাটে পানি তৈরি হয়। মাটিতে গোলাকার চক্র দেখা দেয়ার পর অনেক ক্ষেত্রেই কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একটি স্থান সিংক হোলে পরিণত হতে পারে। এতে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সিংক হোলগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। যেমন লাইমস্টোন বা জিপসাম দিয়ে গঠিত স্তরগুলো পানিতে খুব সহজেই দ্রবীভূত হয়; ফলস্বরূপ স্তরগুলো আরো পাতলা হয়ে উপরের ভার বহন করতে না পেরে মাটিতে তলিয়ে যায়। এ সিংক হোলগুলো প্রাকৃতিকভাবে গঠিত এবং অপ্রতিরোধ্য। মানুষের কারণে কিছু গর্ত তৈরি হয়ে থাকে। ভূগর্ভের পানির অতিরিক্ত আহরণে পানির স্তর নিচে নেমে গর্তের গঠন ত্বরান্বিত করে। এ ক্ষেত্রে পানির স্তর বৃদ্ধি বা গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জের দিকে বিশেষ নজর দিতে হয়। পানির অযথা অপচয় কমিয়ে আনতে হবে। খরা প্রতিরোধে যথাযথ নিয়ম মেনে চলতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, তৈরি হওয়া গর্তগুলো বর্জ্য বা ময়লা ফেলতে ব্যবহার করা হয় যা উচিত নয়। কারণ, ময়লা থেকে তৈরি হওয়া লিচেট অনেক সময় ভূগরর্ভে পানির স্তরে মিশে পানির দূষণ ঘটায়। এতে নানা রকম জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করে রোগের সৃষ্টি করে। তাই সিংক হোলগুলো কোনোভাবে ময়লা আবর্জনা ফেলার কাজে ব্যবহার করা ঠিক নয়।

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে বার্ষিক ৭ দশমিক ৫ মিটার পানি গৃহীত হয় যার ৫ দশমিক ৫ মিটার আসে ভূপৃষ্ঠের পৃষ্ঠতল থেকে। বাকি ২ মিটারের উৎস বৃষ্টির পানি। সুতরাং কৃষিতে সেচে ভূগর্ভের পানি মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলন করা হয়ে থাকে। ব্যবহারের চেয়ে অপচয় হয় বেশি। ফলস্বরূপ পানির তল ৮ মিটারের বেশি নিচে নেমে গেছে। সেই ফাঁকা জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে অধিক ঘনত্বের সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি। এমন অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশেও সিংক হোলের মতো বিপর্যয় হানা দিতে পারে। ভূমিকম্প দেশে খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠছে। সিংক হোলের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকম্প অনেকাংশেই দায়ী। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে সিংক হোল তৈরি করতে পারে চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তাই আমাদের সব সময় সচেতন থাকতে হবে। ভূভাগের পানি উত্তোলনের মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। গ্রাউন্ড ওয়াটার টেবিল রিচার্জের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তাহলেই সিংক হোল নামের বিপর্যয় থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।

লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877