সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০২:০৩ পূর্বাহ্ন

জালিয়াতির উদ্দেশ্যে ই-অরেঞ্জ তৈরি করে সোহেল রানা

জালিয়াতির উদ্দেশ্যে ই-অরেঞ্জ তৈরি করে সোহেল রানা

স্বদেশ ডেস্ক:

প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত বহুল আলোচিত প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ এবং ই-কমার্সভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও নেপথ্যের পরিচালক সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পুলিশ কর্মকর্তা শেখ সোহেল রানার বিষয়ে তদন্তে নেমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তারা জানতে পেরেছেন, প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয় ই-অরেঞ্জ। এর নেপথ্যের কারিগর ছিলেন বনানী থানার সাবেক পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ সোহেল রানা (বর্তমানে ভারতের পুলিশের হেফাজতে)। সাধারণ মানুষতো বটেই, তার প্রতারণার হাত থেকে রেহাই পাননি পুলিশ সদস্যরাও। অস্বাভাবিক কম দামে পণ্য কেনার প্রলোভনে পড়ে ই-অরেঞ্জে

পণ্য কেনা বাবদ লাখ লাখ টাকা দিয়ে ফেঁসে গেছেন অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্য। আর জালিয়াতির এই টাকা দিয়ে দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল। ঢাকায় ১১টি ফ্ল্যাট-প্লট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং পর্তুগাল, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও নেপালে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় তৈরি করেছেন। দেশেও একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে প্রায় শত কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে তার। সোহেলের অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি দেখে রিতিমতো হতবাক তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

প্রতারণার জাল বিছাতে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দেয় ই-অরেঞ্জ প্রতিষ্ঠানটিও। ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির চেয়েও বড় বাজার ধরতে মাস্টারমাইন্ড সোহেলের পরিকল্পনায় প্রকৃত দাম দিয়ে পণ্য কিনে তা অর্ধেক দামে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দিয়ে এ পর্যন্ত ৪০০ কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে ই-অরেঞ্জ। বাজার তারা ধরেছিলেনও; কিন্তু টাকা দিয়েও পণ্য না পাওয়া গ্রাহকরা তাদের জালিয়াতির বিষয়টি জেনে যাওয়ায় ভেস্তে যায় মিশন। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম কয়েকজনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একাধিক মামলা হয়। কয়েক দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় পরিদর্শক সোহেল রানাসহ ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন (সোহেলের বোন), তার স্বামী মাসুকুর রহমানসহ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কয়েকজন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানটির সব ধরনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। তিনিসহ ই-অরেঞ্জ প্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্তদের বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে গতকাল সোমবার ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে তদন্তসংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য দিয়েছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

থানাপুলিশের পাশাপাশি সোহেল রানাসহ ই-অরেঞ্জে জড়িতদের অবৈধ সম্পদ ও দেশে-বিদেশে পাচার করা টাকার খোঁজে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), এনবিআর ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থাও (সিআইডি) অনুসন্ধানে নেমেছে বলেও জানা গেছে।

গতকাল সোমবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির সচিব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার জানান, পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো দুদক তদন্ত করবে। রাষ্ট্রের সম্পদ কাউকে অবৈধভাবে ভোগ করতে দেওয়া হবে না- এই বিষয়ে দুদক সোচ্চার রয়েছে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সচিব আনোয়ার হোসেন জানান, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের বিষয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পায়নি দুদক। ফলে দুদক প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। অভিযোগ পেলে অথবা বাণিজ্য বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তথ্য দিলে ই-অরেঞ্জের বিষয়ে কাজ শুরু করা হবে। ই-অরেঞ্জ সম্পর্কে কিছু কমিশনে আসেনি। ইভ্যালি নিয়ে যেমন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ই-অরেঞ্জ নিয়েও হয়তো জানাবে। তখন আমরা কার্যক্রম শুরু করব। রাষ্ট্রের কেউ যদি অবৈধ সম্পদ অর্জন করে, প্রতারণা করে, আমরা তা দেখব। এটা আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব।

ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গতকাল আমাদের সময়কে জানান, পরিদর্শক সোহেল রানার বিষয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার তদন্ত চলছে। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সোহেল রানার মতো ই-অরেঞ্জ প্রতিষ্ঠানে পুলিশের আর কেউ জড়িত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর কোনো পুলিশ সদস্যের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।

সোহেল রানার বিপুল অর্থ-সম্পদের বিষয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পরিদর্শক সোহেল রানার বাবার নাম শেখ আ. সালাম। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার ঠিকানা- গুলশান মডেল টাউনের সুবাস্তু নজরভ্যালি টাওয়ার ৩-এ। তার ৪ স্ত্রীর প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে দশ বছর ধরে সম্পর্ক নেই সোহেলের। দ্বিতীয় স্ত্রী অভিনেত্রী। তিনি বাড্ডার আফতাবনগর এলাকায় থাকেন। তৃতীয় স্ত্রীর নাম ডল পিউ। অরেঞ্জ বাংলাদেশের মালিক ছিলেন তিনি। লন্ডনে পড়তে গিয়ে সোহেলের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এই ডল পিউর হাত ধরেই শুরু অরেঞ্জ বাংলাদেশের পথচলা। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে লন্ডনে ছিল। তিনি মারা যাওয়ার পর অরেঞ্জ বাংলাদেশের মালিক হন তার দ্বিতীয় বোন সনিয়া মেহেজাবিন জুঁই। করিয়ান ক্লাবের ওয়েটার নাজনিন নাহার বিথি সোহেলের চতুর্থ স্ত্রী। সোহেলের ছোট ভাই শেখ সাইফ বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের দৈত নাগরিক। বোন শিউলি পারভিনের স্বামী সুলতান আলী টিপু। ছোট বোন সনিয়া মেহেজাবিন জুঁই ই-অরেঞ্জের প্রধান নির্বাহী। সোহেলের অধিকাংশ ব্যবসাই এই জুঁইয়ের নামে। তার স্বামী মসিকুর রহমান সুমন বিকাশের বড় কর্মকর্তা।

সোহেলের সম্পদের বিষয়ে জানা গেছে, বিটিআই ল্যান্ডমার্কের পঞ্চম ফ্লোরে রয়েছে কর্মাশিয়াল অফিস স্পেস; গুলশান-২ ডিসিসি মার্কেট কাঁচাবাজারের পেছনে আইটিসিতে ন্যাশনাল ডিলারশিপে (উইনিলিভার ইন্টারন্যাশনাল) লগ্নি করেছেন প্রায় শত কোটি টাকা। নিকেতনের দুটি ফ্ল্যাটের একটিতে থাকেন সাগর নামে তার ছোট খালু। টিঅ্যান্ডজি নামে প্রতিষ্ঠানের দুটি ব্র্যাঞ্চের একটি উত্তরায়। উত্তরা গরিবে নেওয়াজ এভিনিউ, ১৩নং সেক্টর। গুলশানের ব্র্যাঞ্চটি গুলশান-২ ডিসিসি মার্কেটের দ্বিতীয় তলায়। পূর্বাচল ৩নং সেক্টরে প্লট; বসুন্ধরার ই ব্লকে ফ্ল্যাট এবং আই ব্লকে প্লট। খাগড়াছড়িতে রিসোর্টের জন্য কেনা বিস্তর জমি; গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে রয়েছে প্রায় ৫০০ বিঘার ওপরে জমি; গুলশানে বিভিন্ন পণ্যের ডিলারশিপও নিয়েছেন সোহেল; আমেরিকার ক্লাব, জার্মান ক্লাব এবং কুরিনার ক্লাবের মেম্বার ও পরিদর্শক সোহেল রানা। থাইল্যান্ডের পাতায়াতে তার রয়েছে জমি, ফ্ল্যাট, সুপারশপ; হিলটন হোটেলের পাশে ফাইভস্টার হোটেল করার জন্য লগ্নি করেছেন প্রায় শত কোটি টাকা। পর্তুগালের লিজবনে সুপারশপ, বার ও রেস্টুরেন্টে রয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ; প্যারিসে রেস্টুরেন্ট এবং বার। ফিলিপাইনে ম্যানিলা পি বরাজ স্ট্রিটে রয়েছে বার; নেপালের কাঠমান্ডুর গামিল এলাকায় রয়েছে ছোট পরিসরে বার এবং ক্যাসিনো।

সিআইডির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, অভিযোগ অনুযায়ী ই-অরেঞ্জ গ্রাহকের আত্মসাৎ করা প্রায় ১১০০ কোটি টাকা কী করেছে, তা জানতে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে সিআইডি। অগ্রিম টাকা পরিশোধের পরও মাসের পর মাস পণ্য ডেলিভারি না দেওয়ার অভিযোগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে সিআইডি। ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ‘প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাত’-এর ঘটনায় গুলশান থানায় যে মামলা করা হয়েছে তার অনুসন্ধান করা হচ্ছে। মামলাটি প্রতারণার অভিযোগে হলেও অভিযুক্তদের মানিলন্ডারিংয়ের বিষয়টি অনুসন্ধান করছে সিআইডি। পাশাপাশি কী কারণে, হঠাৎ করে গত ১ জুলাই প্রতিষ্ঠানটি মালিকানা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিল, সেই বিষয়টি ছাড়াও ই-অরেঞ্জ বা ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকের কোনো অ্যাকাউন্ট থেকে বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে কিনা তা-ও তদন্তের আওতায় রয়েছে। মামলার আসামিসহ প্রতিষ্ঠানে জড়িত কয়েকজনের তথ্য ও ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানের সন্দেহজনকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অনুসন্ধানে তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের প্রমাণ পেলে মামলা করবে সিআইডি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877